আমার শিক্ষক হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আমার শিক্ষকরাই জুগিয়েছেন। প্রাইমারি, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এমন কয়েকজন শিক্ষককে আমি পেয়েছিলাম যারা আমাকে সবসময় সমৃদ্ধির পথে, ভালো একজন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে উৎসাহিত করেছেন। সেসব শিক্ষকদের অনুপ্রেরণাতেই আমি আজ শিক্ষক হয়েছি।

শিক্ষক দিবসের অনুভূতির কথা জানাতে গিয়ে এভাবেই বলছিলেন ঢাকা কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, শিক্ষক পরিষদ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ড. মো. আব্দুল কুদ্দুস সিকদার।

৮০’র দশকের স্মৃতি রোমন্থন করে বললেন, ১৯৬৭ সালে ফরিদপুরে নিভৃত গ্রামে আমার জন্ম। এরপর শৈশবে পড়াশোনার হাতেখড়ি স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে। প্রচণ্ড ডানপিটে আর চঞ্চল স্বভাবের কারণে শিক্ষক আর বাবার কঠোর অনুশাসন ও অনুরাগের মধ্যে বড় হয়েছি। সেসময় স্কুলের শিক্ষকদের আমরা প্রচণ্ড ভয় পেতাম। একইসঙ্গে তাদের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা-ভালোবাসাও ছিল। যা এখন পর্যন্ত মনে দাগ কেটে আছে। আমরা সবসময় মনে করতাম, শিক্ষকরা আমাদের পরম পূজনীয়। আর তখনকার শিক্ষকরাও ছিলেন শিক্ষার্থীদের জন্য নিবেদিত প্রাণ।

একটি ঘটনা না বললেই নয়। সময়টা ১৯৮৩ সাল। তখন আমি মধুখালী পাইলট হাইস্কুলের ছাত্র। এসএসসি পরীক্ষার ঠিক এক মাস আগের ঘটনা। স্কুলে বেবি স্যার নামের একজন বায়োলজির শিক্ষক ছিলেন। তিনি খুব লম্বা-চওড়া এবং রাগী মানুষ ছিলেন। আমরা তাকে খুব ভয় পেতাম। তখনকার সময় যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এত ভালো ছিল না। একদিন রাতে আমি অবসন্ন হয়ে রেডিওতে ফুল ভলিউম দিয়ে গান শুনছিলাম। ঘুম তাড়াতে আমার মা চাল ভাজা দিয়েছেন। তবুও চোখ ভেঙে ঘুম আসছিল। একপর্যায়ে টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ আমার চুলে টান পড়ায় ব্যথা অনুভব করে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় প্রচণ্ড রাগ হলো। কিন্তু পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখলাম আমার সেই স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম।

তখন সেই রাগী স্যার পরম আদরে আমার কাঁধে হাত রাখলেন এবং বললেন, পরীক্ষার আর মাত্র কিছুদিন বাকি। এখন যদি তুমি ঘুমিয়ে সময় কাটাও তবে পরীক্ষায় ভালো করতে পারবে না। আর এসএসসিতে যদি তোমার লেটার মার্ক না আসে তাহলে নিজের মধ্যেই হতাশা তৈরি হবে। তাই ভালো করে পড়তে হবে। তিনি তখন আমার অন্য বিষয়ের প্রস্তুতির ব্যাপারে জানতে চাইলেন এবং অনেক সমস্যার সমাধানও করে দিলেন। আমি নতুন করে অনুপ্রাণিত হলাম। পূর্ণোদ্যমে পড়াশোনা শুরু করলাম। সেই প্রেরণায় এসএসসিতে আমি সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে পাস করলাম।

পরে জানতে পারলাম স্যার রাতে শিক্ষার্থীদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে পড়াশোনার খোঁজখবর নিতেন এবং কারো কোনো সমস্যা থাকলে তা সমাধান করে দিতেন। সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে আজীবন তিনি এমনভাবে মানুষ গড়ায় নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। একজন শিক্ষক কতটা উদার ও নিবেদিতপ্রাণ হলে শিক্ষার্থীদের জন্য এত কষ্ট করেছেন সেটি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আর এই যুগে এমনটি কল্পনাও করা যায় না। পরে আমি উচ্চমাধ্যমিকে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে পড়াশোনা করেছি। তখন আমার একজন শিক্ষক ছিলেন গাজী আজমল স্যার। তার স্মার্টনেস, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, কথা বলার ধরন, পঠন রীতি, স্নেহ— সবকিছু আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। শুধু তিনিই নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়েও যেসব শিক্ষকরা ছিলেন তারাও নিঃস্বার্থভাবে আমাদের গড়ে তুলতে কাজ করেছেন।

আসলে শৈশব-কৈশোরের তখনকার সময়ে দৃশ্যপটই অন্যরকম ছিল। আমরা বাবা ব্যবসায়ী ছিলেন। স্কুলে যাওয়ার সময় ৮-১০ পয়সা পেতাম। এক টাকা ছিল বর্তমান সময়ের হাজার টাকার সমান মূল্যের। স্কুলে গ্রামের বাজারে তৈরি মালাই-কুলফি, বাদাম, চানাচুর ছিল আমাদের মজাদার টিফিন। অনেক সময় আমরা টাকা না নিয়ে গেলেও শিক্ষকরা এক পয়সা বা দুই পয়সার আইসক্রিম বাদাম কিনে দিতেন। তখনকার সময়ে স্যারদের সংসারেই টানাপোড়েন ছিল কিন্তু তাদের মন অনেক বড় ছিল। সেসব কথা মনে হলে এখনো স্মৃতিকাতর হয়ে যাই।

এখনো যখন আমি অবসরে, পড়ন্ত বিকেলে বা সন্ধ্যায় আমার অতীতকে স্মরণ করি, তখন সেসব শিক্ষকের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। নিজেকে প্রশ্ন করি, এত বছর ধরে শিক্ষকতা করি, আসলেই কি আমি একজন ভালো শিক্ষক হয়ে উঠতে পেরেছি। একজন শিক্ষার্থীর মনে কি আমার অবস্থান আছে। আমি কি আমার শিক্ষার্থীর প্রতি ঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারছি।

সেসব আত্মসমালোচনার জায়গা থেকে বলতে পারি, শিক্ষকরা এখন আর জ্ঞানের আঁধার নয়। আমরা যাদের কাছে পড়াশোনা করেছি তারা যে জ্ঞান অর্জন করেছেন তা দিয়েই আমাদের আলোকিত করার চেষ্টা করেছেন। তখন এখনকার আধুনিক যুগের মতো এই সুযোগ-সুবিধা ছিল না। ঘরে বসে আমি পৃথিবীকে জানতে পারছি, এই সুবিধা তাদের ছিল না। তারপরও তারা আমাদের আলোকিত করেছেন। আজকের আমি হয়ে ওঠার পেছনে সেসব ত্যাগী শিক্ষকদের অবদানই সবচেয়ে বেশি।

দেশে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষক দিবস উদযাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একজন শিক্ষক হিসেবে কেমন বোধ করছেন— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রথমবারের মতো জাতীয়ভাবে সারা দেশে শিক্ষক দিবস পালন করা হচ্ছে তা জানার পর অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি এবং আমার অনুভূতি বহুমুখী। কেননা, বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই শিক্ষকদের মর্যাদা ও কর্মের স্বীকৃতির জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও জাতীয়ভাবে দিবসটি উদযাপন করা হয়। মূলত, শিক্ষার্থীরা যখন শিক্ষকদের কাছে আসেন এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করেন তখন এটি শিক্ষকদের জন্য অনেক বড় আনন্দের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। একজন শিক্ষকের জন্য এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে। সেজন্যই আমার দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, সরকারিভাবে শিক্ষক দিবস পালন করা হোক। এ পর্যায়ে এসে সরকারিভাবে একটি দিন আমাদের স্মরণ করার জন্য মনোনীত করা হয়েছে তা অত্যন্ত আনন্দের। আমরা শিক্ষকরা সরকার প্রধান, শিক্ষামন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং মাউশি মহাপরিচালকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

সেকালের তুলনায় একালের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যকার সম্পর্কের ভিত অনেকটাই নড়বড়ে। কেন এমনটি হলো— এমন প্রশ্নের জবাবে ড. কুদ্দুস বলেন, আমি মনে করি, একজন শিক্ষক তার ছাত্রের কাছে বন্ধু, তার জীবনের দর্শন এবং পরিচালক। যেটা আমরা আগের যুগের শিক্ষকদের মধ্যে পেয়েছি। যেমন তারা যখন হাঁটতেন, তারা সাধারণ মার্জিত পোশাকে ধীরস্থিরতার সঙ্গে পথ চলতেন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থাকত, আমি যে শিক্ষক তা যেন চারপাশের মানুষ বুঝতে পারেন। তাদের নৈতিকতা ও চিন্তাচেতনায় সেবার ব্রত ছিল। আমার কাছে মনে হয়, বর্তমানে আমরা সেই জায়গা থেকে অনেকটাই সরে এসেছি। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের ফারাকের এটি একটি বড় কারণ হতে পারে।

আবার আমরা এখন শিক্ষকতাকে নিছক চাকরি মনে করি। কিন্তু এটি তো নিছক চাকরি নয়, বরং একটি ব্রত। এরপর আরও একটি বড় কারণ, বর্তমান সমাজ এবং অভিভাবকরা আগের তুলনায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যেমন আগে একজন ছাত্রকে পড়াশোনার জন্য, নৈতিকতা শেখানোর জন্য শিক্ষকরা অনেক পিটিয়েছেন বা শাসন করেছেন। কিন্তু বাবা-মা কিংবা অভিভাবক কখনোই সেখানে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। এখন সময় বদলে গেছে। কোনো শিক্ষার্থীকে একজন শিক্ষক গায়ে হাত দেওয়া দূরে থাক, তাকে শাসনও করতে পারেন না। এখানে রাষ্ট্রেরও নীতিমালা আছে যে, শিক্ষক শিক্ষার্থীর গায়ে হাত দিতে পারবেন না। সবমিলিয়ে শাসনের পরিমাণও অনেক কমেছে। ফলে শিক্ষার্থীদেরও নৈতিক স্খলন ঘটেছে। ফলশ্রুতিতে প্রভাব পড়ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ওপর।

শিক্ষক হিসেবে জাতির কাছে বা রাষ্ট্রের কাছে আপনাদের প্রত্যাশার জায়গা কতটুকু— জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি যদি ব্যক্তিগতভাবে বলি, তাহলে আমরা শিক্ষকরা রাষ্ট্রের কর্মচারী হিসেবে বেতন পাই। সেটা একটা দিক। কিন্তু একইসঙ্গে একজন শিক্ষকের যে সামাজিক স্বীকৃতির জায়গা, সম্মানের জায়গা সেটিও রাষ্ট্রকে তৈরি করে দিতে হবে। একজন শিক্ষকের জন্য তার কর্মপরিবেশ, কর্মস্থলে তার নিরাপত্তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে পেশাগত যে অসন্তোষ আছে সেগুলোও দূর করতে হবে। বিশেষ করে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা অন্যান্য ক্যাডারের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে আছেন। শিক্ষকদের নিয়মিত পদোন্নতি নেই, ইনক্রিমেন্টও নেই। শিক্ষা ক্যাডারে এই সংকটগুলো প্রকট। এ বিষয়গুলো সমাধানে সরকার তথা রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি ছাত্র, শিক্ষক, রাষ্ট্র সবাইকে একচিন্তায় এসে শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই কোয়ালিটি এডুকেশন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

আরএইচটি/এসএসএইচ