বিজেএসে প্রথম হওয়া নুসরাত
একাডেমিক রেজাল্ট ভালো মানে ৬০ ভাগ চাকরির প্রস্তুতি সম্পন্ন
১৬তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফলে সহকারী জজ হিসেবে সারা দেশে প্রথম স্থান অর্জন করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থী নুসরাত জেরিন জেনি ৷ রোববার (২৪ সেপ্টেম্বর) জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এ নিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো রাবির শিক্ষার্থীরা এই পরীক্ষায় প্রথম স্থান দখল করে রেখেছেন।
বিজেএস পরীক্ষায় প্রথম হওয়া নুসরাতের বাড়ি গাইবান্ধা হলেও বেড়ে উঠেছেন বগুড়ায়। এ.কে.এম. আব্দুর নুর ও মোছা. শিরীন তাজ বেগমের তিন সন্তানের মধ্যে নুসরাত বড়। নুসরাতের বাবা বাসুদেবপুর চন্দ্র কিশোর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ও মা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। তার মা-বাবা উভয়ই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী।
বিজ্ঞাপন
নুসরাতের স্কুল জীবনের শুরু বগুড়ার বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখান থেকে জিপিএ-৫ নিয়ে এসএসসি পাস করেন। এরপর বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করেন। সহকারী জজ নিয়োগে এটি তার দ্বিতীয় পরীক্ষা। এর আগে ১৫তম বিজিএস পরীক্ষা দেন তিনি। কিন্তু সেবার প্রিলিতেই অকৃতকার্য হন নুসরাত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী নুসরাত জেরিন জেনি স্নাতকে ৩ দশমিক ৮৩ সিজিপিএ অর্জন করেছেন। স্নাতকে সর্বোচ্চ সিজিপিএ অর্জন করায় ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক’-এ মনোনীত হয়েছেন নুসরাত। বর্তমানে স্নাতকোত্তরে পড়ছেন নুসরাত। স্নাতকোত্তরেও সর্বোচ্চ সিজিপিএ আশা করছেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
আনন্দ প্রকাশ করে নুসরাত ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার পড়ালেখা চলাকালীন সময়ে আমি সহকারী জজ হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। এটা আমার জন্য অনেক বেশি গর্বের। আমি অনেক বেশি কৃতজ্ঞ আমার সৃষ্টিকর্তার প্রতি। যার ইচ্ছাই আমি সহকারী জজ হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। এ সফলতার পেছনে আমার মা-বাবা, শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণের অবদান অনেক। তাদের প্রতি আমি চির কৃতজ্ঞ।
পরীক্ষার প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা পোস্টকে নুসরাত বলেন, আমার সঙ্গে যারা সহকারী জজ হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তারা কেউই আমার থেকে কম মেধাবী না। সহকারী জজ হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হতে আমার অবশ্যই অনেক বেশি চেষ্টা ছিল। তবে পড়াশোনার জন্য আমার নির্দিষ্ট কোনো রুটিন ছিল না। আমার যখন যেমন পড়াশোনার প্রয়োজন হত, আমি তখন সেভাবেই পড়তাম। এমন হয়েছে যে, সারাদিনে একদমই পড়াশোনা হয়নি। আবার এমন হয়েছে, সারাদিনই পড়াশোনা করেছি। তবে যখন অনেক পড়া জমা যেত কিংবা পরীক্ষার সময় আসত তখন অনেক বেশি পড়তাম।
একাডেমিক পড়াশোনা কতটা কাজে লাগে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিজেএস পরীক্ষায় আইন সম্পর্কিত বিষয় একটা শক্তিশালী জোন। ফলে আইনের বিষয়গুলোর ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কেউ চাইলে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সাধারণ জ্ঞান, বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিভাগগুলোতে একটা সন্তোষজনক নম্বর তুলে ও আইনের বিষয়গুলোতে বেশি নম্বর তুলেও বিজেএস পরীক্ষায় ভালো করতে পারেন। এছাড়া সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয়ের প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বিজেএস পরীক্ষার পূর্ববর্তী প্রশ্নগুলো দেখে তবে যার যে বিষয়ে দুর্বলতা বেশি, তার সেই বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করি। যাদের রিটেনে লেখার হাত ভালো তাদের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। কারণ বিজেএস পরীক্ষায় ‘রিটেন’ অনেক বড় একটা ফ্যাক্ট।
বিজেএস পরীক্ষায় একাডেমি ফলাফল কতটা কাজে লাগে জানতে চাইলে নুসরাত ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসলে বিজেএস পরীক্ষায় একাডেমিক রেজাল্টের গুরুত্ব নেই বললেই চলে। একাডেমিক রেজাল্টের কারণে বিজেএস পরীক্ষায় বাড়তি কোনো সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় না। এমনকি ভাইভাতেও যে দুই মার্কস বাড়িয়ে দেবে এমনটাও না। তবে এটা সত্য, বিজেএস পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থী তখনই ভালো করে যখন তার একাডেমিক রেজাল্ট ভালো থাকে। কারণ সে একাডেমিক বিষয়গুলো ভালো করে পড়েছে। একাডেমিক রেজাল্ট ভালো হওয়া মানে ৬০ ভাগ জবের প্রিপারেশন সম্পন্ন হওয়া।
যারা আইন নিয়ে পড়তে চান তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আইন খুবই ভালো একটা সাবজেক্ট। যদি কেউ আইন নিয়ে পড়তে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই আইনকে ভালোবাসতে হবে। আইনের বিষয়গুলোর ওপর ভালো লাগা কাজ করাতে হবে।
বিজেএসে যারা ভালো করতে চায়, তাদের উদ্দেশ্যে নুসরাত জেরিন জেনি বলেন, যাদের সহকারী জজ হওয়ার ইচ্ছে তাদের অবশ্যই আইনের বিষয়গুলোতে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ কেউ চাইলেই শুধুমাত্র আইনের বিষয়গুলোর ওপর পরীক্ষা দিয়ে ৬০০ নম্বরের মধ্যে ৪৫০-৫০০ নম্বর অনায়াসে তুলতে পারবেন। আইনের বাইরের বিষয়গুলো অনেক সময় কমন পড়ে না। ফলে সেগুলো লিখতে অনেক সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। এর থেকে আইনের বিষয়গুলোর ওপর নম্বর তোলা সহজ। পাশাপাশি গ্রামারের দিকে খেয়াল রেখে দ্রুত লেখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ বিজেএস পরীক্ষায় লিখিত বিষয়ে অনেক নম্বর থাকে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বছরের কোর্সগুলোর মধ্যে যেগুলো বিজেএস পরীক্ষায় সিলেবাসভুক্ত সেগুলোতে ফাঁকি না দিয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে পড়া উচিত। ফলে তার জন্য বিজেএস পরীক্ষায় ভালো করা অনেক বেশি সহজ হবে বলে আমি মনে করি। তবে বিজেএস সিলেবাসের বাইরের বিষয়গুলোও ভালো করে পড়া উচিত। এগুলো অবহেলা করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। কারণ ভাইভাতে এগুলো থেকেও কিছু প্রশ্ন থাকে।
এসময় নুসরাত বলেন, বিজেএস পরীক্ষায় ভালো করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো বর্ষ আমি উল্লেখ করতে চাই না। কে কখন প্রিপারেশন নেবে সেটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। কেউ যদি মনে করে তার প্রথম বর্ষ থেকে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত, তাহলে সে প্রথম বর্ষ থেকেই পড়াশোনা করবে। আবার কেউ যদি মনে করে, সে অনার্স পরীক্ষার পরে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ভালো করতে পারবে, তাহলে তার সেটাই করা উচিত। তবে নির্দিষ্ট করে যদি বলতেই হয়, তাহলে বলব তৃতীয় বর্ষ থেকে বিজেএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া ভালো।
নিয়োগ পাওয়ার পর দেশের হয়ে কী করতে চান জানতে চাইলে ঢাকা পোস্টকে নুসরাত বলেন, বিচারক অনেক মার্যাদার একটা আসন। এর সঙ্গে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও বিশ্বাস জড়িত। সর্বোচ্চ সৎ থেকে যেন ভালো কিছু করে যেতে পারি তার জন্য আমার যা কিছু করা দরকার আমি ততটুকুই করে যাব। আল্লাহ আমাকে যে সম্মান দিয়েছেন সেই সম্মান রেখে যেন আমি চলতে পারি তার জন্য আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে।
এ সময় কথা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. হাসিবুল আলম প্রধানের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের পরপর চারটি পরীক্ষায় আমাদের আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রথম হয়েছেন। এটি আমাদের বিভাগের জন্য একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এটি আমাদের বিভাগের জন্য একটি মাইলফলক। এবার আমাদের নুসরাত ১৬তম সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন। সবচেয়ে আনন্দের যে বিষয় আমাদের যে পরপর চারজন প্রথম হয়েছে তাদের তিনজনই মেয়ে। অর্থ্যাৎ নারীর ক্ষমতায়ন, নারীও যে এগিয়ে যাচ্ছে তারও প্রতিফলন লক্ষ্য করছি আমাদের এই ফলাফলে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বিভাগের শিক্ষকদের ডেডিকেশন এবং শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও আমাদের সিলেবাসে নতুন নতুন বিষয় যুক্ত করা, তারই সামগ্রিক ফলাফল ধারাবাহিকভাবে চারবার প্রথম হওয়া।
এমজেইউ