ছাত্রলীগের উপস্থিতি ও নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে রাবিতে গণ-ইফতার
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (নোবিপ্রবি) ইফতার পার্টির ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে এবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণ-ইফতার অনুষ্ঠিত হয়েছে। বুধবার (১৩ মার্চ) বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে অনুষ্ঠিত হয় এটি। তবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাটকীয়তায় পূর্ণ ছিল আয়োজনটি।
সরেজমিনে দেখা যায়, আসরের পর থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনুষ্ঠানস্থলে জড়ো হতে থাকলে তাদের সেখান থেকে চলে যেতে বলতে থাকেন মাদার বখস্ হল শাখা ছাত্রলীগের নেতা তামিমসহ কয়েকজন। তাদের পাশেই উপস্থিত ছিলেন শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব। কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থলে আসেন শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবু।
বিজ্ঞাপন
শিক্ষার্থীদের চলে যেতে বলার বিষয়ে বিকেল পৌনে ছয়টার দিকে আসাদুল্লা-হিল-গালিব বলেন, আমরা কাউকে সরিয়ে দেইনি। এটার আহ্বায়ক জোহা কোথায়? একসঙ্গে ইফতার করার জন্য আমরা তাকে ডেকেছিলাম। সে কোথায়? এই আয়োজনের জন্য তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা কারো থেকে প্রশাসন থেকে অনুমতি নেয়নি।
এসময় হঠাৎ ঘটনাস্থলে আসেন ইফতার আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক ও আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী জায়েদ এইচ জোহা। জোহাকে নিয়ে মুক্তমঞ্চের পিছনে একান্তে কথা বলেন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। কথা শেষে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইফতার হবে বলে ঘোষণা দেন।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
এসময় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব বলেন, আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গণ-ইফতার নামে কর্মসূচির বিষয়টি দেখেছি। এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অবগত না, ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোও অবগত না। আমরা এখানে এসে জটলা দেখতে পেয়েছি। এই আয়োজনের আহ্বায়ক জোহার সঙ্গে কথা বলে আমরা রাবি শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ইফতারে অংশগ্রহণ করেছি, যাতে ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা না ঘটে। সেজন্য ক্যাম্পাসের পাহারাদার হিসেবে আমরা শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এই ইফতার কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছি।
তিনি আরো বলেন, আমাদের কাছে তথ্য ছিল ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা নোমানীর মৃত্যুবার্ষিকী আজ। সেই উপলক্ষ্যে তারা আজ ক্যাম্পাসে কোনো একটা কর্মসূচি পালন করবে। সেটা নামে-বেনামে হতে পারে। এই আয়োজনের আহ্বায়ক জোহা শিবিরের সঙ্গে জড়িত আছে কী না জানি না। তার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, সে জড়িত না। তার সাথে হয়তোবা ইফতারের পরে আরে কথা হবে। আপাতত ধর্মপ্রাণ মুসল্লি হিসেবে আমরা সবাই একসঙ্গে ইফতার করব। ইফতার শেষে তার সঙ্গে কথা বলবো।
এরপর জোহাকে কাছে বসিয়ে ইফতার করেন শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ইফতারে বিভিন্ন বিভাগের কয়েকশত শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।
ইফতার শেষে ঘটনা আবার নাটকীয়তায় মোড় নেয়। সবাইকে নামাজে যেতে বললেও, জোহার সঙ্গে কথা বলবে বলে জানান ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এই বলে জোহাকে অন্যত্র নিয়ে যেতে চাইলেও, তিনি শহীদ মিনার প্রাঙ্গণেই কথা বলার অনুরোধ করেন তাদের। এরপরও তাকে বারবার অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তারা। এসময় শতশত শিক্ষার্থীর পাশাপাশি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান এবং সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক মনি ফেরদৌস। এই দুই শিক্ষক নামাজ শেষে জোহার সঙ্গে কথা বলার জন্য বলেন ছাত্রলীগ নেতাদের। এঘটনায় ওই দুই শিক্ষক ও শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হয়।
এসময় ঘামতে দেখা যায় জায়েদ এইচ জোহাকে। একপর্যায়ে তিনি বলেন, আমি শারীরিকভাবে অসুস্থবোধ করছি। তখন ওই দুই শিক্ষক ছাত্রলীগ নেতাদের বলেন, তোমরা পরে, কাল বা পরশু ওর সঙ্গে কথা বলতে পারবা। ওকে যেতে দাও। এরপর আবার জোহার সঙ্গে একান্তে কথা বলে এসে সবার সামনে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক জোহাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে কিনা? তখন জোহা বলেন, যাবো ভাই। এরপর উপস্থিত ওই শিক্ষক বলেন, তাকে আমরা তোমাদের জিম্মায় দিলাম। তার যেন কিছু না হয়।
এরপর জোহাকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরেবাংলা হলের পিছনে একান্তে প্রায় আধাঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেন ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে একটি রিকশা ডেকে তাকে তার মেসে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন তারা।
এসময় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ওকে শিবির সন্দেহে এনেছিলাম। ওর (মোবাইল থেকে) মেসেঞ্জার ঘেঁটে দেখলাম, সবই ছাত্রশিবির সম্পর্কে লেখাবার্তা, ছাত্রলীগ বাঁধা দিচ্ছে ইফতারে, মানে একেকজনের একেকরকম তথ্য দেওয়া। ওই শিবির করে, এমন কোনো তথ্য নাই ওখানে। কিন্তু গণ-ইফতার কর্মসূচি নামে একটা গ্রুপে আছে, সেখানে ছাত্রলীগ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কনভারসেশন আছে। যেমন, ছাত্রলীগ ইফতার করতে দিচ্ছে না, মানে ওকে ইনফর্ম করছে সবাই, এটা হচ্ছে, ওটা হচ্ছে। এগুলো দেখে, ওকে ছেড়ে দিয়েছি।
এসম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান বাবু বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠন ধর্মীয় ইস্যুকে ব্যবহার করে সাধারণ স্টুডেন্টের ইমোশনকে ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। তাই আমি ও আমার সাধারণ সম্পাদক সেখানে উপস্থিত হয়ে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে ইফতার করেছি। যেন কোনো প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে না পারে।
প্রসঙ্গত, শাবিপ্রবি এবং নোবিপ্রবিতে ইফতার পার্টির ওপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে এই বিশ্ববিদ্যালয় দুটিসহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে গণ-ইফতার কর্মসূচি পালন করে নীরব প্রতিবাদ জানিয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার (১২ মার্চ) রমজানের প্রথম দিন পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে শাবিপ্রবি ও নোবিপ্রবিসহ মোট ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণ-ইফতারের আয়োজন করা হয়।
গত সোমবার (১১ মার্চ) শাবিপ্রবির উপ-রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ইফতার পার্টি আয়োজন না করার নির্দেশ দেওয়া হয়। একইদিনে নোবিপ্রবির রেজিস্ট্রার ড. মুহাম্মদ আলমগীর সরকার স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ইফতার পার্টি আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বিজ্ঞপ্তি দুটিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রেক্ষিতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট সকলকে আসন্ন রমজান মাসে ক্যাম্পাসে ইফতার পার্টির আয়োজন না করার জন্য অনুরোধ জানানো হলো।
আরও পড়ুন
বিশ্ববিদ্যালয় দুটির ইফতার পার্টি না করতে এমন নির্দেশনা দেওয়ায় দেশজুড়ে শুরু হয় তুমুল সমালোচনা। দেশের ধর্মপ্রাণ মুসল্লির পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা তুমুল সমালোচনা ও প্রতিবাদ জানান। শুধু ওই দুটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এই সমালোচনা ও প্রতিবাদ ছড়িয়ে পরে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মুক্তচর্চার প্রতিষ্ঠানের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে মিছিল ও মানববন্ধন করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিবাদস্বরূপ গণ-ইফতারের ডাক দেয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
তীব্র সমালোচনার মুখে শাবিপ্রবি অভ্যন্তরে ইফতার পার্টি আয়োজন না করার অনুরোধ জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দেওয়া বিজ্ঞপ্তি পরিবর্তন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মঙ্গলবার (১২ই মার্চ) সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ নির্দেশনা জানানো হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নতুন বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রতিবছর রমজান মাসে ইফতার পার্টি আয়োজনে বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তরগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্থিক সহায়তা করা হতো। তবে এ বছর পবিত্র রমজান মাসে সরকারিভাবে বড় করে ইফতার পার্টি উদযাপন না করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রেক্ষিতে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ কমাতে এবারের রমজানে সংশ্লিষ্ট কাউকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হবে না। তবে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট যে কেউ নিজেদের অর্থায়নে ইফতার পার্টির আয়োজন করতে পারবে।
জুবায়ের জিসান/পিএইচ