সিন্ডিকেটে আওয়ামীপন্থিদের উপস্থিতি, পদত্যাগের দাবি জবি ঐক্যের
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া সিন্ডিকেট সদস্যরা এখনো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছেন বহাল তবিয়তে। আজ (সোমবার) বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১তম সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে পরিচিত শিক্ষক প্রতিনিধিরা। এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে জবি ঐক্য। একই সঙ্গে ওই শিক্ষকদের পদত্যাগের দাবি করে প্রশাসন বরাবর একটি স্মারকলিপিও দিয়েছে সংগঠনটি।
স্মারকলিপিতে জবি ঐক্যের নেতারা চার শিক্ষকের পদত্যাগের দাবি জানান। তারা হলেন- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াস হোসেন, জবির আইন অনুষদের ডিন খ্রীস্টিন রিচার্ডসন, ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম মনিরুজ্জামান এবং প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. লাইসা আহমেদ লিসা।
বিজ্ঞাপন
এ স্মারকলিপি দেওয়ার পর অধ্যাপক ড. লাইসা আহমেদ লিসা উপাচার্য বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম হলো সিন্ডিকেট। দীর্ঘদিন ধরে ফ্যাসিবাদের দোসরদের বাদ দিয়ে নতুন সিন্ডিকেট গঠন করার দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এ বিষয়ে প্রশাসনের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি।
বিজ্ঞাপন
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৫ অনুযায়ী, সিন্ডিকেট সদস্য থাকবেন ১৬ জন। উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ও রেজিস্ট্রারসহ সরকার কর্তৃক মনোনীত ন্যূনতম দুজন যুগ্ম সচিব, সরকার কর্তৃক মনোনীত শিক্ষা ও গবেষণা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান হতে দুজন, ইউজিসি থেকে একজন, আচার্য থেকে মনোনীত দুজন শিক্ষাবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন থেকে তিনজন এবং একাডেমিক কাউন্সিল থেকে তিনজন সিন্ডিকেট সদস্য হবেন।
জানা যায়, আজকের সিন্ডিকেট সভায় আমন্ত্রণ পেয়েছেন উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. সানজিদা ফারহানা, লাইফ অ্যান্ড আর্থ সায়েন্স অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মল্লিক আকরাম হোসেন ও আইন অনুষদের ডিন খ্রীস্টিন রিচার্ডসন, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক ড. মো. মোশাররফ হোসেন, একই বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম মনিরুজ্জামান, প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. লাইসা আহমেদ লিসা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন ভূঁঞা, রাবির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াস হোসেন, জবির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক ড. রইছ উদ্দিন, সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদসহ সরকার মনোনীত দুজন যুগ্ম সচিব।
এর মধ্যে অধ্যাপক ড. ইলিয়াস হোসেন ২০২১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন নির্বাচনে আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষকদের হলুদ প্যানেল থেকে নির্বাচিত হন। তার বিরুদ্ধে একাডেমিক সভায় অশালীন ভাষা ব্যবহার করে সহকর্মী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মামুনকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ রয়েছে।
আরও পড়ুন
ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম মনিরুজ্জামান ২০১৫ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগ সমর্থিত শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সমর্থনে ২০১৭ সালে জবি শিক্ষক সমিতির সভাপতিও নির্বাচিত হন তিনি। আওয়ামীপন্থি এ শিক্ষক ২০২৩ সালে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন।
জবির প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের ড. লাইসা আহমেদ লিসা একই সঙ্গে ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতি কর্মীদের আঁখড়া খ্যাত ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। অপর ফ্যাসিবাদের দোসর ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সনজিদা খাতুন ছিলেন তার সম্পর্কে শাশুড়ি। সনজিদা খাতুনও ছায়ানটের পদ ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাব খাটাতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
যা বলছেন অভিযুক্ত শিক্ষকরা
সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. এ কে এম মনিরুজ্জামান বলেন, আমি ৫ আগস্টের পরই পদত্যাগ করতে চেয়েছিলাম। যেহেতু আমি একাডেমিক কাউন্সিল কর্তৃক মনোনীত, তাই আমার পদত্যাগের বিষয়ে একাডেমিক কাউন্সিল থেকে এখনো কিছু বলা হয়নি। সে কারণে পদত্যাগ করিনি। তবে আজ যে ঘটনাটি ঘটেছে, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পরই আমি পদত্যাগপত্র জমা দেব— এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আরেক সিন্ডিকেট সদস্য খ্রীস্টিন রিচার্ডসন বলেন, আমি ডিন হিসেবে মনোনীত হয়েছি, তাই আমি সিন্ডিকেট সদস্য হয়েছি ডিন হিসেবে। আজ যদি আমি ডিন না থাকতাম, তাহলে সিন্ডিকেট সদস্যও থাকতাম না। তারপরও আমার নামটি কেন ওখানে এসেছে, সেটাই বুঝতে পারছি না! হয়ত ছাত্ররা এটা না বুঝে করেছে।
তবে, বাকি দুই সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. লাইসা আহমেদ লিসা ও অধ্যাপক ইলিয়াস হোসেনের সঙ্গে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তারা কল রিসিভ করেননি।
যা বলেছেন উপাচার্য ও জবি ঐক্যের প্রতিনিধিরা
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম বলেন, আমরা একজনের পদত্যাগপত্র পেয়েছি। ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। বাকিদেরও বলা হয়েছে পদত্যাগের বিষয়ে। তবে, ডিন হিসেবে একজন সিন্ডিকেট সদস্যের পদত্যাগের বিষয়টি যেহেতু পদের ওপর নির্ভর করে, তাই এ পদে যেই থাকবেন তিনিই সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে মনোনীত থাকবেন।
জবি ঐক্যের প্রতিনিধি ও জবি শাখা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের আহ্বায়ক মাসুদ রানা বলেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সেক্টর থেকে স্বৈরাচারদের দোসরমুক্ত করার জন্য প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানানোর পরও আজ ফ্যাসিস্টদের নিয়ে সিন্ডিকেট মিটিং বসানো হয়েছে। আমরা চাই, অতি দ্রুত সময়ে স্বৈরাচারের দোসরদের সিন্ডিকেট থেকে বের করে জুলাই আন্দোলনের পক্ষের শক্তিকে নিয়ে সিন্ডিকেট পুনর্গঠন করতে হবে।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের নেতা নূর নবী বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে এখনো এমন কিছু ব্যক্তি রয়েছেন, যারা অতীতে স্বৈরাচারী সরকারের দমনমূলক নীতির সহযোগী ছিলেন। তারা ছাত্রদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছেন, বহিষ্কার করেছেন এবং পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন। এমন ব্যক্তিদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ক্ষমতায় রাখা দুঃখজনক ও লজ্জাজনক। আমরা দাবি জানাই—স্বৈরাচারের সহযোগীদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে অপসারণ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় হোক মুক্ত চিন্তার নিরাপদ স্থান, কোনো শাসকের নয়।
জবি শাখা ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রায়হান হাসান রাব্বি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে এখনো স্বৈরাচারের দোসর কীভবে বসে? আমাদের ত্যাগ কী এজন্য ছিল? এক বছর হতে না হতেই আমাদের শিক্ষকরাও তাদের সাথে বসা শুরু করেছেন। তাই একজন জুলাই যোদ্ধা হিসেবে আমি এটা মেনে নিতে পারি না। দোসরদের স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে হবে।
এমএল/এমএ