ফিরে দেখা-২০২৪
রাবিতে শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে ক্যাম্পাস ছেড়ে পালায় ছাত্রলীগ
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই, বিকেলটা ছিল অন্য দশটা দিনের মতোই। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে দিনটি এক বীরত্বগাথার প্রতীক হয়ে আছে। সেদিন শত শত শিক্ষার্থী লাঠি, রড ও পাইপ হাতে এগিয়ে যান নিজের ক্যাম্পাস পুনরুদ্ধারের যুদ্ধে। ১৫ বছরের অধিক সময় ধরে ক্যাম্পাস দখলে রাখা ছাত্রলীগকে সেদিন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলে দেন তারা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে ছাত্রলীগমুক্ত ক্যাম্পাস।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও সাবেক সমন্বয়কদের সঙ্গে কথা বলে সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে জেনেছে ঢাকা পোস্ট। তাদের বরাতে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মোড় ঘুরে যায় ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করার মাধ্যমে। দিনটি ছিল ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। সেদিন শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি ছিল দুপুর আড়াইটায়। তবে শিক্ষার্থীদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি নস্যাৎ করতে এক ঘণ্টার ব্যবধানে একই স্থানে জমায়েতের ডাক দেয় ছাত্রলীগ। কিন্তু সবকিছু গোপন রেখে দুই-তিন ঘণ্টা আগে থেকে শিক্ষার্থীদের বের হয়ে আসতে বলা হয়।
বিজ্ঞাপন
১৬ জুলাই (২০২৪) দুপুর আড়াইটায় বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর থেকে দুই-আড়াইশোর মতো শিক্ষার্থী নিয়ে একটি দল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে যায়। সেখানে প্রায় ১০০ জনের মতো পুলিশ থাকলেও তারা কোনো বাধা দেয়নি। সে সময় ছাত্রলীগের হাত থেকে প্রতিরোধের জন্য সবার হাতে ছিল রড, পাইপ ও লাঠিসোঁটা।
শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে প্রবেশের ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তেই সব হলের শিক্ষার্থীরা হল থেকে বের হতে থাকেন। বিক্ষোভ মিছিলটি জোহা চত্বরের পশ্চিম পাশ দিয়ে প্যারিস রোডে এলে বিপরীত দিক থেকে কয়েকশ শিক্ষার্থী এসে মিলিত হয়। মিছিলটি মেয়েদের হলের সামনে এলে হাজার দেড়েকের মতো মেয়ে শিক্ষার্থী তাতে যোগ দেন।
বিজ্ঞাপন
মিছিলটি বিজ্ঞান ভবনের পাশ দিয়ে হবিবুর রহমান হলের মাঠ দিয়ে শহীদ জিয়াউর রহমান হলের সামনে আসে। সেসময় শিক্ষার্থীরা হলের সামনে অবস্থান নেওয়া ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের হলের ভেতর থেকে প্রতিহত করতে শুরু করেন। সেখানে ইটপাটকেল খেয়ে মাদার বখ্শ হলের সামনে যায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ততক্ষণে সোহ্রাওয়ার্দী ও জোহা হলের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শাহ মখ্দুম, লতিফ ও আমীর আলী হলের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ-হিল গালিবকে তাড়া করেন।
ফলে সাড়ে ১৫ বছরের রাজত্ব ফেলে মোটরসাইকেলে চড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সাধারণ সম্পাদক গালিবের পালানোর ১০ সেকেন্ডের ভিডিও ব্যাপক ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তার হলের কক্ষটি ভাঙচুর চালায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এরপর বিক্ষোভ মিছিলটি বিজয় ২৪ হলের (তৎকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল) ভেতরে ঢুকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের রুম ভাঙচুর করে। শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবুকে পুলিশ উদ্ধার করে অন্যত্র নিয়ে যায়। ছাত্রলীগের সভাপতি ও সেক্রেটারির কক্ষ এবং দপ্তর সেল থেকে তিনটি পিস্তল, ছয়টি রামদা, ১০-১৫টি মদের বোতল, কয়েকটি দা-সহ রড উদ্ধার করেন বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা। পরে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রগুলো রাবি প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করেন তারা।
সেদিন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পালিয়ে যাওয়া প্রত্যক্ষ করেন সাবেক সমন্বয়ক মেশকাত মিশু। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৬ জুলাই (২০২৪) শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি ছিল দুপুর আড়াইটায়। এ কর্মসূচিকে নস্যাৎ করতে একই স্থানে জমায়েতের ডাক দেয় সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ। এছাড়া প্রতিটি হলের সামনে চেয়ার পেতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে তারা। কয়েকটি হলের গেটে তারা তালা মেরে দেয় যাতে হলে থাকা শিক্ষার্থীরা কর্মসূচিতে যেতে না পারে। তাদের সব ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে সেদিন সবচেয়ে বড় আন্দোলন সংঘটিত হয়।
তিনি আরও বলেন, ওইদিন আমি ছাত্রলীগের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য মাদার বখ্শ হলের সামনে যাই। দেখি ছাত্রলীগের সেক্রেটারি গালিব তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে বেঞ্চে বসে আছে। কিছুক্ষণ পরেই কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর একটি বিক্ষোভ মিছিল আসাদুল্লাহ-হিল গালিব ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের তাড়া করে। এতে তারা আতঙ্কিত হয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। নিমেষেই তাদের দীর্ঘদিনের মসনদ ভেঙে খান খান হয়ে যায়। বিরল সে মাহেন্দ্রক্ষণ স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য আমার হলো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে ছাত্রলীগমুক্ত প্রথম ক্যাম্পাস।
আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী সানজিদা ঢালি। তিনি বলেন, ১৬ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ছিল। ওই ঘটনার জন্য আমাদের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল ১৫ তারিখ থেকেই। যদিও আন্দোলনের সময় নির্ধারণ ছিল ১৬ জুলাই বিকেল ৩টা। তবে, ছাত্রলীগের সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কায় আমরা গোপনে সময় এগিয়ে এনে দুপুর আড়াইটায় আন্দোলন শুরুর সিদ্ধান্ত নিই। মেয়েদের হলগুলোর সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। সেই অনুযায়ী আমি ১৬ তারিখ দুপুর ১টা থেকেই মন্নুজান হলে ঘণ্টা বাজিয়ে ডাকাডাকি শুরু করি এবং আন্দোলনের জন্য মেয়েদের জড়ো করতে থাকি। পরে একত্রিত হয়ে আমরা অন্যান্য হলেও যাই এবং স্লোগানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আহ্বান জানাতে থাকি।
তিনি আরও বলেন, সব হলের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে যখন মন্নুজান হলের সামনে অবস্থান নেয়, তখন দেখি ছেলেরা প্যারিস রোড হয়ে মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসছে। আমরা মেয়েরা সেই মিছিলে যুক্ত হই এবং একসঙ্গে পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করি। আমাদের মিছিলে উপস্থিতির সংখ্যা এতটাই বড় এবং শক্তিশালী ছিল যে ছাত্রলীগ তখন ভয়ে পালিয়ে যেতে শুরু করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সমন্বয়ক মেহেদী সজীব বলেন, ১৬ জুলাই আমরা সর্বপ্রথম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করি। এরপর ওইদিন রাতে এবং পরেরদিন সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করা হয়। মূলত ছাত্রলীগকে বের করার মাধ্যমেই ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান রচিত হয়। ইতোপূর্বে ফ্যাসিস্ট রেজিমের পেটোয়া বাহিনীকে আমরা ক্যাম্পাস থেকে বের করতে পারিনি এবং ছাত্রলীগই বারবার আমাদের আন্দোলনকে মারপিট করে দমন করেছিল। যা আমরা ২০১৮ সালেও দেখেছিলাম। তাই আমি মনে করি এই ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করার মাধ্যমেই নতুন বাংলাদেশের শুভ সূচনা হয়েছে।
জুবায়ের জিসান/এমএ