প্রতিষ্ঠার পর কখনো হয়নি বেরোবির ছাত্রসংসদ নির্বাচন
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) প্রতিষ্ঠার ১৭ বছরেও কখনো হয়নি কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ব্রাকসু)। ২০০৮ সালের ১২ অক্টোবর যাত্রা শুরুর পর থেকেই আওয়ামী শাসনামল হওয়ায় ক্ষমতার জোরে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। তাদের হাতে নির্যাতন, হয়রানি ও চাঁদাবাজির স্বীকার হয়েছে অসংখ্য শিক্ষার্থী।
গত বছরের ১৬ জুলাই বৈষমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বেরোবির ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৮তম সিন্ডিকেট সভায় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র-শিক্ষকসহ সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন এবং লেজুড়বৃত্তিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগ তদন্ত সাপেক্ষে প্রামাণিত হলে ১১১তম সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘সর্বোচ্চ শাস্তি আজীবন বহিঃষ্কার ও ছাত্রত্ব বাতিল’ করা যেতে পারে, প্রয়োজনে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী শাস্তি বিধানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
বিজ্ঞাপন
বেরোবির সাধারণ শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন যাবৎ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে তাদের অধিকার আদায়, গণতান্ত্রিক চর্চা, ন্যায্য দাবি, আদায়সহ বিভিন্ন কারণে ছাত্রসংসদের দাবি জানিয়ে আসছে। গত মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর শহীদ আবু সাঈদের এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতেও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিটি আরও জোরালো হয়ে উঠেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের ৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদে পাস হওয়া বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ছাত্র সংসদের কোনো বিধান রাখা হয়নি। যার কারণে নির্বাচন করতে হলে প্রথমে ছাত্র সংসদ আইনের খসড়া অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটে পাস করে তা অনুমোদনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে হবে। বিধানটি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে সংযুক্ত হলে তারপরেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হবে এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় আইনের-২০০৯-এ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের নীতিমালা যুক্ত করার জন্য কাজ শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বিজ্ঞাপন
বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে জানা যায়, ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেট কর্তৃক ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নীতিমালা’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই নীতিমালা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় চ্যান্সেলর মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুমোদনের জন্য ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে প্রেরণ করা হয়েছে। এই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের নিমিত্তে ছাত্র সংসদ-সংক্রান্ত স্বতন্ত্র ব্যাংক হিসাব নম্বরে অর্থ সংরক্ষণ করা, ভোটার তালিকা প্রণয়নসহ যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। নীতিমালা অনুমোদন হলে যথা শিগগিরই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে।
আরও পড়ুন
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকার সচেতন সাধারণ শিক্ষার্থীরাও ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তাদের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন সভা, সেমিনার ও সমাবেশে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের জোরালো দাবি তুলে ধরছেন।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষার্থী আহমাদুল হক আলবির বলেন, ‘ক্যাম্পাসে সহিংসতা, দখলদারিত্ব এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের মতো ঘটনাগুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতি ও অনীহা সৃষ্টি করেছে। ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করতে বিরোধীদের দমন এবং ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে রেখেছিল। ছাত্র সংসদ নির্বাচন চালু থাকলে, ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মধ্যে একটি ভারসাম্য তৈরি হতো এবং একক আধিপত্য বিস্তার করা কঠিন হতো। এতে ক্যাম্পাসে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকবে এবং শিক্ষার্থীরা তাদের মতামত প্রকাশ করার সুযোগ পাবে। এর মাধ্যমে ক্যাম্পাসে 'আওয়ামী জাহেলিয়াতের' মতো পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আশ্বাস দিলেও দীর্ঘদিন সময় নিয়ে ছাত্রসংসদের বিষয় অগ্রসরমান কিছু না দেখিয়ে ওনাদের ব্যার্থতা প্রকাশ করছে। প্রশাসনের উচিত শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা এবং ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া’।
শিক্ষার্থী এস এম আশিকুর রহমান বলেন, ৫ আগস্টের পর শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি ছিল ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং ছাত্র সংসদ নির্বাচন। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে ও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ এখনো দেওয়া হয়নি। ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য ছাত্র সংসদের বিকল্প নেই। দ্রুত সব জটিলতা কাটিয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জোর দাবি জানাচ্ছি।
শিক্ষার্থী তানভীর হাসান দিপু বলেন, একটি দেশের পার্লামেন্ট যেমন গুরুত্বপূর্ণ এবং পার্লামেন্ট দেশের মানুষের জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমি মনে করি, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের জন্য ছাত্র সংসদ ঠিক ততটাই ভূমিকা রাখে।
আরেক শিক্ষার্থী মো. শামসুর রহমান সুমন বলেন, অভ্যুত্থান-পরবর্তী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় দেশের বিপ্লবী ধারায় উজ্জীবিত এক অনন্য ক্যাম্পাস। লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছে আমরা সেটিকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু গণতান্ত্রিক চর্চা ও শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য আগামী ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানাই।
এ বিষয়ে বেরোবি উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. শওকাত আলী ঢাকা পোস্টের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, ছাত্র সংসদ করার জন্য কোনো সংবিধি ছিল না তাই নতুন সংবিধি প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। কমিটি সব স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলে একটি খসড়া সংবিধি দেয় সেটি ছাত্র, শিক্ষক, শিক্ষার্থী কর্মকর্তাসহ সবার সম্মতিক্রমে পরিবর্তন পরিমার্জন করা হয় এবং আমরা সেটি সিন্ডিকেটে পাশ করি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে পাঠিয়েছি, সেটি মঞ্জুরি কমিশনে আছে।
তিনি শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে বলেন, একটি সংবিধি নতুনভাবে সংযোজন করতে হলে তার অনেকগুলো প্রক্রিয়া পার করতে হয়। আমাদের প্রক্রিয়া শিক্ষার্থীদের দাবির আগেই শুরু করেছি। আমরা আশা করি, অতি শিগগিরই এটি সম্পন্ন করতে পারব এবং ছাত্র সংসদের সংবিধি পূর্ণাঙ্গ পাশ হয়ে আসবে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এএমকে