রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ এবং সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন-২০২৫ ঘিরে ইতিমধ্যে সরব হয়ে উঠেছে পুরো ক্যাম্পাস। নির্বাচনের আর মাত্র দুই দিন বাকি। শেষ সময়ে এসে প্রার্থীরা বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়ে ও নানা রকম প্রচারণার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মন জয় করার চেষ্টায় ব্যস্ত। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতে, দীর্ঘদিনের স্থায়ী সমস্যাগুলোর বাস্তবসম্মত সমাধান না হলে এসব ইশতেহার শুধু কথার ফুলঝুরি হয়েই থাকবে।

রাকসুর আলোচিত প্যানেলগুলো আগেই তাদের ইশতেহার ঘোষণা করলেও ছাত্রদল সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ প্যানেল তাদের ইশতেহার ঘোষণা করেছে গতকাল। ঘোষিত ইশতেহারগুলোতে প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন- আবাসন সংকট, খাবার ও সুপেয় পানির অভাব, চিকিৎসা অব্যবস্থা, একাডেমিক জটিলতা, লাইব্রেরি ও ল্যাবের সীমাবদ্ধতা, নিরাপত্তাহীনতা, পরিবহন সমস্যা, গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের প্রসারের ওপর।

ছাত্রদল সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ প্যানেলের ইশতেহারে এসেছে বৈচিত্র্য। তারা ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারিকে ড. শামসুজ্জোহার শাহাদাত দিবস 'জাতীয় শিক্ষক দিবস' হিসেবে ঘোষণার দাবি তুলেছেন। পাশাপাশি বিবাহিত শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা আবাসিক হল নির্মাণের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। প্যানেলটির ভিপি (সভাপতি) প্রার্থী শেখ নূর উদ্দিন আবীর বলেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের মতামত নিয়েই আমরা ইশতেহার সাজিয়েছি। আমরা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, তার কোনোটাই অসম্ভব নয়। শিক্ষার্থীরা আমাদের পাশে থাকলে এবং প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারলে আমরা অল্প সময়েই এসব বাস্তবায়ন করতে পারব।

রাকসু নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ইশতেহার দিয়েছে শিবির সমর্থিত প্যানেল 'সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট'। তারা ১২ মাসে ২৪টি সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইশতেহারে ৭টি বিষয়কে ‘হ্যাঁ’ বলে জোর দিয়েছে প্যানেলটি। সেগুলো হলো, শিক্ষা ও গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ, আবাসন সংকট নিরসন, মানসম্মত খাবার নিশ্চিতকরণ, নিরাপদ ক্যাম্পাস, তথ্যসেবা ও আধুনিকায়ন , সকল অংশীজনের মাঝে সুসম্পর্ক বৃদ্ধি, সুচিকিৎসা নিশ্চিতকরণ।

অন্যদিকে ৭টি বিষয়কে ‘না’ বলেছে এই প্যানেল। সেগুলো হলো, ৫০ টাকা হল ফি, হল দখল ও সিট-বাণিজ্য, ট্যাগিং ও ফ্রেমিংয়ের রাজনীতি, স্লাট শেমিং-সাইবার বুলিং ও শারীরিক নির্যাতন, ধর্মবিদ্বেষ, মাদক ও ছিনতাই, সন্ত্রাস ও সহিংসতা।

প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান জাহিদ বলেন, আমরা মনে করি, ১২ মাসে এই ২৪টি সংস্কার করা সম্ভব। এগুলো শেষ করেও আরও কিছু কাজ করার সুযোগ থাকবে বলে আশা করি। আমাদের ইশতেহার ১ বছরের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য করেই সাজানো হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, 'সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট' প্যানেল অনেক আগেই ১২ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেছে। তাদের অন্যতম দাবির মধ্যে রয়েছে উপাচার্য নির্বাচন চালুর উদ্যোগ। ভিপি পদপ্রার্থী তাসিন খান বলেন, রাকসুর ভিপি, জিএস ও অন্যান্য পদগুলোর ক্ষমতা বিবেচনায় নিয়েই আমরা ১২টি বাস্তবসম্মত প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। আমরা নির্বাচিত হলে ১ বছরের মধ্যেই তা বাস্তবায়ন করব।

বামপন্থী ছাত্রসংগঠন সমর্থিত ‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’ প্যানেলের ইশতেহারে গুরুত্ব পেয়েছে রাকসুর কাঠামো সংস্কার, ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষার্থীদের ক্ষমতায়ন। ভিপি প্রার্থী ফুয়াদ রাতুল বলেন, আমরা রাকসুকে গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস বিনির্মাণের একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখি। জুলাই আন্দোলনে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার ছিলাম। নির্বাচিত হতে পারলে আমরা শিক্ষার্থীদের আবাসন, খাদ্যসংকটসহ বিভিন্ন সমস্যা নিরসনে কাজ করব।

অন্যদিকে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতিগুলোতে নতুন কিছু নেই। তাদের মতে, আসল বিষয় হলো এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবে কতটা কার্যকর হবে এবং তা আদৌ বাস্তবায়িত হবে কি না। অনেক শিক্ষার্থী আশঙ্কা করছেন, কিছু প্রার্থী গঠনতন্ত্রের সীমা ছাড়িয়ে এমনসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, যেগুলোর বাস্তবতার সঙ্গে কোনো মিল নেই এবং সেগুলো শুধুই ভোট পাওয়ার কৌশল।

ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী রাফায়েল মারুফ বলেন, প্রার্থীদের অনেক প্রতিশ্রুতিই নতুন নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এসব কতটা বাস্তবায়নযোগ্য। অনেক প্রার্থী সীমার বাইরে গিয়ে বড় বড় কথা বলছে, যেগুলো সম্ভব নয়। তাই আমাদের সতর্কভাবে ভোট দেওয়া উচিত, যাতে যোগ্য ও সৎ প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী হাসিবুল ইসলাম বলেন, রাকসু গঠনতন্ত্র অনুযায়ী একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন, তাই এর ক্ষমতা সীমিত। তবে যেহেতু এটি সকল শিক্ষার্থীর ম্যান্ডেট নিয়ে গঠিত, তাই চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে এটি একটি প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। তবে অনেক ইশতেহার বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না। যেমন ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের বিবাহিতদের জন্য হল নির্মাণের দাবি বাস্তবায়ন অসম্ভব। বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সেশনজট। রাকসু চাইলে এই সমস্যা সমাধানে চাপ প্রয়োগ করতে পারে।

উল্লেখ্য, দীর্ঘ ৩৫ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে রাকসু নির্বাচন। এবারের নির্বাচনে মোট ৯০৩ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে রাকসুতে ২৪৮ জন, সিনেটের ছাত্র প্রতিনিধি পদে ৫৮ জন এবং ১৭টি আবাসিক হল সংসদে ৫৯৭ জন প্রার্থী লড়ছেন। আগামী ১৬ অক্টোবর একযোগে অনুষ্ঠিত হবে রাকসু, হল সংসদ ও সিনেট-এ ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। ভোটগ্রহণ শেষে সেদিনই ফলাফল ঘোষণা করা হবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়/এআরবি