মায়ের দেওয়া ৩০০ টাকায় জীবন বদলে যায় মাসুদের
প্রায় ৩৫ বছর আগে মায়ের দেয়া ৩০০ টাকার পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বড়ইতলি গ্রামের মাসুদ রানা। আজ তিনি সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ‘পরিশ্রম ও সততা মানুষকে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দেয়’— এ প্রবাদ বাক্যের একটি দৃষ্টান্ত মাসুদ রানা।
প্রত্যেক মানুষের সফলতার পেছনে থাকে ছোট ছোট গল্প। মাসুদ রানাও তার ব্যতিক্রম নন। ৩৫ বছর আগে মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর পর চার বোন ও মাকে নিয়ে এক অনিশ্চিত পথে যাত্রা শুরু হয়। এরই মধ্যে মা ও বোনদের রেখে বড় ভাই সংসার থেকে আলাদা হয়ে গেলে দিশেহারা হয়ে পড়েন মাসুদ।
বিজ্ঞাপন
ছয়জনের দেখভালের দায়িত্ব পড়ে ভাই মাসুদের ওপর। সন্তানের এমন অসহায়ত্ব দেখে মা তার ছাগলটি ৩০০ টাকায় বিক্রি করে মাসুদের হাতে তুলে দেন ব্যবসা করার জন্য। আর এই পুঁজিই হয় মায়ের দোয়া।
মাসুদ জানান, ১৯৮৫ কি ’৮৬ সালের দিকে কালিয়াকৈর বাজারে রাস্তার ধারে পেঁয়াজুর একটি দোকান দেন তিনি। প্রথম দিকে বিক্রি কম হলেও ধীরে ধীরে তার বিক্রি বাড়তে থাকে। পেঁয়াজুর স্বাদ আশপাশে ছড়াতে থাকে। সুস্বাদু পেঁয়াজুর স্বাদ পেতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ভিড় করে। সেই ৩০০ টাকার পুঁজির ব্যবসায় মাসুদ আজ স্বংসম্পূর্ণ। করেছেন বাড়িঘর, বিয়ে দিয়েছেন বোনদের, সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার চেষ্টায় আছেন। পাশাপাশি বাজারে করেছেন ‘সাড়ে তেরো রেস্টুরেন্ট’ নামের একটি খাবারের দোকান।
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার (১ মার্চ) কালিয়াকৈর বাজারে কথা হয় মাসুদের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি যখন ব্যবসা শুরু করি, তখন কালিয়াকৈর বাজারটি তেমন জমজমাট ছিল না। হাতেগোনা কিছু দোকান ছিল বাজারে। প্রথমে চার আনা ও আট আনা দামে পেঁয়াজু বিক্রি করি। পর্যায়ক্রমে আমার পেঁয়াজুর সুনাম আশপাশে ছড়াতে থাকে। এখন দূরদূরান্ত থেকে পেঁয়াজু খেতে আসে মানুষ। আমি পণ্যের মানের সঙ্গে কখনোই আপস করিনি।
পেঁয়াজুর দোকানের পাশাপাশি কয়েক বছর আগে মাসুদ কালিয়াকৈর বাজারেই সাড়ে তেরো রেস্টুরেন্ট নামের নতুন খাবারের দোকান খুলেছেন। রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় সফল হলেও তার মূল ব্যবসা বা আকর্ষণ এখনো পেঁয়াজুতে। প্রতিদিন তার ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার পেঁয়াজু বিক্রি হয়। এ ছাড়া বিশেষ দিনগুলোয় পেঁয়াজু বিক্রি লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
মাসুদ রানা দুই ধরনের পেঁয়াজু তৈরি করেন। একটি হলো ঝাল পেঁয়াজু, আরেকটি সাধারণ পেঁয়াজু। প্রতি কেজি পেঁয়াজু ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। তার পেঁয়াজু শুধু ডাল ও পেঁয়াজ দিয়েই বানানো হয়।
গুণের ক্ষেত্রে পুরোটাই আপসহীন মাসুদ মিয়া জানান, রিজিক মহান আল্লাহ নির্ধারণ করে দেন।
উদ্যোক্তা মাসুদ বলেন, দুই দোকান মিলিয়ে ২৮ পুরুষ শ্রমিক ও বাড়িতে ৬ নারী শ্রমিক দৈনিক কাজ করেন। আমি রোদে পড়েছি, বৃষ্টিতে ভিজেছি, তবু ধৈর্যহারা হইনি। যখন কাজ করেছি, তখন শুধু মা ও চার বোনের কথা মাথায় আসত। ধৈর্য, পরিশ্রম আর সততাই আমাকে আজ এ জায়গায় নিয়ে এসেছে।
দুই ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে মাসুদ দ্বিতীয়। বাবা বেঁচে থাকাকালীন দুই বোনকে বিয়ে দিয়ে যান। বাকি চার বোনকে ব্যবসা শুরুর কিছুদিন পর পর্যায়ক্রমে বিয়ে দেন তিনি।
জীবনের মূল্যবান সুযোগও হারিয়ে মাসুদ বলেন, একসময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে আমার চাকরির সুযোগ এসেছে। কিন্তু আমি চাকরিতে যোগ না দিয়ে ব্যবসাকেই আঁকড়ে ধরি। এখন এ ব্যবসাতে আমি খারাপ নেই, বরং ভালোই আছি। আমার সংসারে দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ছেলে নবম শ্রেণিতে ও দুই মেয়ে উচ্চমাধ্যমিকে পড়াশোনা করছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আমির হোসেন বলেন, জীবনে কী করে সফলতা পেতে হয়, মাসুদ তার অনন্য উদাহরণ। কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাকে কাজ করতে দেখেছি। কোনো দিন তাকে অসুস্থতা গ্রাস করতে পারেনি। দোকানসহ কারাখানায় শ্রমিকদের সঙ্গে সমান তালে কাজ করেন তিনি।
কালিয়াকৈর বাজারের ব্যবসায়ী জয়নাল বলেন, মাসুদের পেঁয়াজু খেতে দূরদূরান্ত থেকে অনেক মানুষ আসে। তারা এখানে বসেও খান আবার সঙ্গে নিয়েও যান। আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে গেলে দই-মিষ্টির পাশাপাশি অনেকে এই সুস্বাদু পেঁয়াজুও নিয়ে যান।
কালিয়াকৈর উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান জানান, একজন সফল উদ্যোক্ত ও ব্যবসায়ী মাসুদ রানা। তার এই সফলতা বেকার যুবকদের মাঝে অনুপ্রেরণা জোগাবে।
এনএ