ভূমধ্যসাগরে নিখোঁজদের ১৫ জনই নরসিংদীর
‘দুইডা পায়ে ধরি, আমার পোলাডারে আইন্না দেন’
লিবিয়া থেকে সাগরপথে ইতালি পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশি কয়েকজন নাগরিক। তবে তাদের বহনকারী ট্রলারটি ভূমধ্যসাগরে ডুবে যায়। ওই ট্রলার থেকে ২৮ জন নিখোঁজ হন বলে বাংলাদেশি একাধিক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফেরা ইউসুফ মৃধা। নিখোঁজদের অন্তত ১৫ জনই নরসিংদীর বাসিন্দা বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বেঁচে ফেরা ইউসুফের বর্ণনা অনুযায়ী, প্রতিকূল আবহাওয়ায় ২৫ জনের ধারণক্ষমতার ট্রলারে ৩৫ জনকে নেওয়া হয়েছিল। ২৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় লিবিয়া উপকূল থেকে ট্রলারটি ছাড়ে। দুটি ইঞ্জিন দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয় একটি। ছিল না সেফটি জ্যাকেট।
বিজ্ঞাপন
রাত ৩টার দিকে মাল্টার কাছাকাছি পৌঁছালে ট্রলার থেকে একজন পানিতে পড়ে যান। তাকে তুলতে গিয়েই ট্রলারটি কাত হয়ে উল্টে পড়ে এবং ডুবে যায়। ট্রলার ছাড়ার দিনই পরিবারের সঙ্গে শেষবারের মতো যোগাযোগ হয় তাদের।
ট্রলারডুবির পর ভূমধ্যসাগরের ঢেউয়ে কে কোনদিকে গেছেন— তা শনাক্ত করা যায়নি। ৩৫ যাত্রীর মধ্যে ছয়জন বেঁচে ফিরেছেন, তাদের দুজন এরইমধ্যে বাংলাদেশে ফিরেছেন। একজন মারা গেছেন। বাকিরা এখনো সাগরে নিখোঁজ। তাদের মধ্যে অনেকের বাড়ি রায়পুরা উপজেলায়। ভুক্তভোগী কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে ঢাকা পোস্ট, দেখেছে স্বজনদের মধ্যে চলছে মাতম।
বিজ্ঞাপন
ফোনে চার্জ রাখি, কিন্তু ছেলের কল আর আসে না
‘পোলা আমারে কইছিল, বাবা তুমি ফোন চার্জ দিয়া রাইখো। আমি পৌঁছাইয়া কল দিমু। সেই কল আর আসেনি।’
কথাগুলো বলছিলেন ট্রলারডুবিতে নিখোঁজ নাদিম সরকারের পিতা সুবহান সরকার। তাদের বাড়ি রায়পুরা উপজেলার ডৌকারচর ইউনিয়নে। নাদিম এ বছর শিবপুরের আবদুল মান্নান ভূঞা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে।
সুবহান সরকার আরও বলেন, ‘২৭ জানুয়ারির পর থেকে আমার ছেলের আর খোঁজ নাই। এদিকে দালালরা কল ধরে না। ছেলে কোথায় আছে জানি না। ইতালি পৌঁছে কল করার কথা ছিল। আমি প্রতিদিনই ফোনে চার্জ রাখি। ছেলের কল আর আসে না।’
দালালরা বলে, অলৌকিক ঢেউ নাকি তাদের নিয়ে গেছে
নিখোঁজ আল আমিন ফরাজীর মেয়ে বিথী আক্তার। রায়পুরার বেলায়েত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী সে। বাবার সঙ্গে শেষ কথা হয় ২৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায়। বিথীকে তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই চোখ ছলছল করে ওঠে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে সে বলে, ‘দালালরা বলে অলৌকিক ঢেউ নাকি তাদের নিয়ে গেছে। বাবা অনেক আদর করতো। যা বলতাম, এনে দিতো। আমাদের দুই ভাই-বোনের কী হবে এখন?’
আল আমিন ফরাজীর স্ত্রী রুবি বেগম বলেন, ‘তারেক দালাল আর মনির দালাল ভরসা দিয়েছিল আমাদের। এখন আমার স্বামী কোথায় আছে জানি না। দালালদের বিচার চাই।’
পোলাডারে আইন্না দিবেন, দুইডা পায়ে ধরি
‘আমার পোলাডারে আইন্না দিবেন? দেন না আইন্না। দুইডা পায়ে ধরি। দয়া করেন একটু ..’ সাংবাদিক দেখে হাত জোড় করে আকুতি করছিলেন সাগরে নিখোঁজ শাওন মিয়ার মা সুলেমা বেগম।
শাওন হাসনাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। তার বাবার নাম কবির মিয়া। ২৭ জানুয়ারি থেকে সে নিজেও নিখোঁজ।
শাওনের মা সুলেমা বেগম বলেন, ‘হাসনাবাদ এলাকার মাহবুব নামে একজনের সঙ্গে ছেলেকে ইতালি পাঠানোর চুক্তি হয় আট লাখ টাকায়। ছয় লাখ টাকা অগ্রিম দিয়েছি। বাকি দুই লাখ পৌঁছানোর পর দেওয়ার কথা। ২৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় শেষ কথা হয় আমার ছেলের সঙ্গে। তখনও জানতাম না সাগরপথে যাবে। বৈধ বলে যারা অবৈধ পথে নিতে নিয়েছে তাদের বিচার চাই।’
ছেলের নিখোঁজের খবর শুনে পাথর বাবা
ভূমধ্যসাগরে ট্রলার ডুবির ঘটনায় নিখোঁজ এস এম নাহিদের বাড়ি রায়পুরা উপজেলার আমীরগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ মির্জানগর গ্রামে। স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা শেষ করেন তিনি। পরিবারের হাল ধরতে ২৫ বছর বয়সের এ তরুণ পাড়ি দিয়েছিলেন ইতালির উদ্দেশে। ২৭ জানুয়ারির পর ছেলের নিখোঁজ সংবাদ পেয়ে পাথর হয়ে যান বাবা ওসমান গণি।
নাহিদের ভাই মো রুবায়েত বলেন, ‘আশা রাখি, আমার ভাই ফিরবে। যদিও ২৭ জানুয়ারির পর থেকে আর কোনো খোঁজ নেই তার। কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই আমাদের। আমার ভাই ফিরবে কিংবা তার খোঁজ মিলবে— সে আশায় আছি।
ছেলের ছবিটাই একমাত্র স্মৃতি
‘চার ছেলের একজনের খোঁজ নাই গত ২৭ জানুয়ারির পর থেকে। ছেলের এ ছবিটা ছাড়া আর কোনো স্মৃতি নাই আমার কাছে। জীবিত কিংবা মৃত, যেভাবেই হোক আমার ছেলেকে আমি আমার কাছে চাই।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে এভাবে বলছিলেন রায়পুরার হাসনাবাদ বাজার এলাকার নিখোঁজ আশিষ সূত্রধরের মা শবিতা রানী সূত্রধর। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে এ বছর ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছিল। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম আমার ছেলেকে। উঠতি বয়সের ছেলে আমার দালালদের খপ্পরে পড়ে আমাদের অমতেই গেছে বাড়ি থেকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাসনাবাদের দালাল তারেক মোল্লা আর বিদেশ থেকে মনি শীল কাজ করতো। টাকা পয়সা সব ঠিকঠাক দিয়েছি আমি। তবুও আমার ছেলের খোঁজ নেই। মৃত হলে লাশটাই চাই আমরা।’
আশিষ সূত্রধরের বড় ভাই আনন্দ সূত্রধর বলেন, ‘ইতালির কথা বলে দালালরা আমার ভাইকে দুবাই, মিশর ও সবশেষ লিবিয়া নেয়। ইতালি না নিয়ে লিবিয়া নেওয়ার বিষয়ে তারেক মোল্লাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি উল্টো খারাপ আচরণ করেন। লিবিয়ায় থাকা মনি শীলও কিছু বলেন না। ২৭ জানুয়ারি ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের সবশেষ কথা হয়। শুনেছি তাদের ট্রলারটি ডুবে গেছে। জীবিত কিংবা মৃত— ভাইকে ফেরত চাই।’
ভূমধ্যসাগরে ট্রলারডুবিতে নরসিংদীর নিখোঁজদের নাম জানিয়েছে স্থানীয় একটি সূত্র। সে অনুযায়ী নিখোঁজদের তালিকায় রয়েছেন, নাদিম সরকার, আল-আমিন ফরাজী, এস এম নাহিদ, শাওন মিয়া, আশিস সূত্রধর, আলমগীর সরকার, ইমরান মিয়া, সবুজ মিয়া, সেলিম মিয়া, আল আমিন, মতিউর রহমান, শরীফুল ইসলাম, সালাউদ্দিন, মো. হালিম ও বিপ্লব মিয়া (২৪)।
এদিকে, অভিযুক্ত ‘দালাল’ তারেক মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয় ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে। তবে তার ফোন নম্বরটি বন্ধ রয়েছে। বাড়িতে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। দরজায় তালা ঝুলতে দেখা গেছে।
নরসিংদীর পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম জানিয়েছেন, এ ঘটনায় ইতোমধ্যে এক দালাল ও তার সহযোগীসহ মোট দুজন গ্রেফতার হয়েছেন। মনি চন্দ্র শীল নামে এক দালাল দেশের বাইরে অর্থাৎ লিবিয়ায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। স্থানীয় মূল দালাল তারেক মোল্লাসহ পুরো চক্রটিকে ধরার চেষ্টা চলছে। তারেককে ধরলেই আরও অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে।’
রাকিবুল ইসলাম/আইএসএইচ