সুতাং নদী এখন ২০০ গ্রামবাসীর জন্য অভিশাপ
একসময়ের আশীর্বাদের সুতাং নদী এখন অভিশাপে পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়ত দখল-দূষণের কারণে নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। এতে একদিকে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। আবার নদীর পানি শরীরে লেগে বিভিন্ন রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে। প্রায় এক কিলোমিটার পর্যন্ত গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় নদীপাড়ের মানুষের জীবন এখন হুমকির মুখে।
শিগগিরই নদীদূষণ বন্ধ না হলে তিন উপজেলার দুই শতাধিক গ্রামের লোকজনের স্বাভাবিক জীবনযাপন বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে খনন না হওয়ায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী নদীটি। ফলে জৌলুশ হারিয়ে সুতাং নদীর বিষাক্ত পানির দুর্গন্ধে আশপাশের তিনটি উপজেলার বাসিন্দাদের জীবন নাভিশ্বাস হয়ে উঠেছে।
বিজ্ঞাপন
সূত্রমতে, সুতাং নদী হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ, সদর উপজেলা ও লাখাই উপজেলা হয়ে মেঘনা নদীতে গিয়ে শেষ হয়েছে মোহনা। নদীটির দৈর্ঘ্য ৮২ কিলোমিটার। আগে নদী থেকে সুস্বাদু মাছ সংগ্রহ করে মৎস্যজীবীরা জেলার বিভিন্ন স্থানে মাছ সরবরাহ করতেন। পাশাপাশি নদীর পানি আশপাশের জমিতে কৃষিকাজে ব্যবহার করা হতো। এখন অবৈধ গড়ে ওঠা বিভিন্ন শিল্পকারখানার দূষিত বর্জ্যে নদীর পানি দূষিত হয়ে পরিবেশ ও মাছের অস্তিত্ব-সংকটে পড়েছে।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলার উচাইল গ্রামের বাসিন্দা ৭০ বছরের বৃদ্ধ আব্দুর রহিম জানান, একসময় সুতাং নদীতে সুস্বাদু মাছ পাওয়া যেত। এখন শিল্পবর্জ্যের কারণে পানি দূষিত হয়ে মাছ সব মরে গেছে। বর্জ্যের বিষাক্ত পানিতে গ্যাসে সৃষ্টি হচ্ছে। নদীর পানি শরীরে লাগলে বিভিন্ন ধরনের রোগ-জীবাণু ছড়ায়। দূষিত পানির গন্ধে এলাকায় বসবাস করার দায় হয়ে পড়েছে।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয় সাধুর বাজার এলাকার ব্যবসায়ী কামাল হোসেন জানান, পানি এতটাই দূষিত হয়েছে যে নদীর পানি ধানের জমিতে দিলে ধানের চারা মরে যায়। এখানকার গরু-ছাগল নদীতে নামানো হলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে গরু-ছাগল মারা যাচ্ছে।
স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক গুলনাহার বেগম জানান, নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে পড়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। আমরা স্কুলে আসা-যাওয়ার সময় নাখ-মুখ ঢেকে আসতে হয়। গন্ধে এলাকায় থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আমরা চাই কর্তৃপক্ষ দ্রুত এর সমাধান করবে।
স্থানীয় মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা হারিসুল হক জানান, সুতাং নদী একসময় মাছে ভরপুর ছিল। নদী থেকে মাছ ধরে এলাকার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু বর্তমানে বিষাক্ত বর্জ্যে পানি দূষিত হয়ে দুর্গন্ধে এলাকায় বসবাস করা দায় হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, বারবার প্রশাসনকে বিষয়টি জানানো হলেও কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে এলাকার পরিবেশ বিনষ্ট হয়ে যাবে।
স্থানীয় ভাদগরি গ্রামের মফিজুল হক জানান, সুতাং নদীর পানি বিষাক্ত হওয়ার কারণে আমরা নদী পার হয়ে আসা-যাওয়া করায় ডাক্তারের কাছে প্রতিনিয়ত সিরিয়াল ধরতে হয়। পানি শরীরে লাগলেই বিভিন্ন স্থানে পচন আর খোস ফোটে। আমরা এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বিষয়টি নজরে আনার জন্য প্রশাসনের দৃষ্টি কামনা করছি।
হবিগঞ্জ পরিবেশ আন্দোলন বাপার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল জানান, এক দশক থেকে হবিগঞ্জে শিল্পদূষণ শুরু হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন নদী দূষণের চরম আকার ধারণ করেছে। শতাধিক কলকারখানার বর্জ্যে নদী ও জলাশয়ে নিক্ষেপের ফলে দিন দিন নদীদূষণ বেড়েই চলছে। বিশেষ করে সুতাং নদী এখন বিপন্ন হয়ে পড়ছে।
তিনি আরও বলেন, দূষণের কারণে সুতাং নদী ঘেরা লোকজন বিপন্ন হয়ে পড়ছে। এলাকার পরিবেশ ও মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অবিলম্বে এই নদীদূষণ রক্ষা করা না হলে সাধারণ লোকজন উত্তরণের পথ খুঁজে পাবে না।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান মোতাচ্ছিরুল ইসলাম জানান, এলাকায় বসবাসে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। শিল্পবর্জ্যের কারণে দিন দিন পানি তার স্বাস্থ্য হারিয়েছে। এতে মানুষের নানা রোগবালাই হচ্ছে। আমি উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে বিষয়টি বারবার প্রশাসনের নজরে আনার চেষ্টা করেছি।
তিনি আরও বলেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই এলাকার পরিবেশে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। আমি প্রশাসনসহ পরিবেশ সংশ্লিষ্টদের কাছে অনুরোধ দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে সুতাং নদীটিকে বাঁচাতে হবে।
হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান ঢাকা পোস্টকে জানান, নদী দূষণকারীদের মার্চ মাস পর্যন্ত আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে। এরপরও যদি কলকারখানার দূষিত বর্জ্য নদীতে ফেলা হয়, তাহলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এনএ