বাসার দরজা খোলা। দুয়ারে দাঁড়িয়ে আহাজারি করছিলেন মা বুলবুলি বেগম। ঘরের ভেতরে কাঁদছিলেন একমাত্র বোন লাভলী সামাদ। পুরো বাসার সবার অপেক্ষা বুলবুলের জন্য। অথচ আসন্ন রমজানেই বাড়িতে আসার কথা ছিল তার। কিন্তু রমজান শুরুর আগেই দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ গেছে দন্ত চিকিৎসক আহমেদ মাহি বুলবুলের। এখনো তার নিথর দেহটি রংপুরের বাড়িতে পৌঁছায়নি।

রোববার (২৭ মার্চ) ভোরে রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন গরিবের ডাক্তার হিসেবে পরিচিত আহমেদ মাহি বুলবুল। তার গ্রামের বাড়ি রংপুর নগরের ভগিবালাপাড়ায়। ৩৪ বছর বয়সী চিকিৎসক বুলবুল ‘ভূমি’ নামে একটি সংগঠনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতেন।

দুপুরে রংপুরে বুলবুলের বাড়িতে গিয়ে তার বিধবা মা বুলবুলি বেগমের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের। বুলবুলি বেগম বলেন, গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিয়ে ছেলের সঙ্গে  কথা বলেছি। ওর বাচ্চাদের জন্য দুধ কিনতে মোবাইলে দুই হাজার টাকা পাঠিয়েছে। ২০ রমজানে বাসায় আসার কথা ছিল। কিন্তু কোথা থেকে কী হয়ে গেল, কিছুই বুঝতে পারছি না।

ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে তিনি বলেন, আমার মনে হয় এ ঘটনার সঙ্গে কেউ জড়িত আছে। প্রশাসন একটু খতিয়ে দেখলে আসল ঘটনা বের হবে। মোবাইল ফোন ঘেঁটে দেখুক। আমার ছেলের তো কোনো শত্রু নেই। তারপরও এই ঘটনা কেন ঘটলো? ছেলের খুনিদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। আমি বিচার চাই।

দন্ত চিকিৎসক আহমেদ মাহি বুলবুল দিনাজপুরে বিয়ে করেন। তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। তার আট বছরের মেয়ে আহমেদ আফনা নাউন ও সামি নামে দেড় বছর বয়সী ছেলে সন্তান রয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তসহ সব প্রশাসনিক প্রক্রিয়া শেষ হলে বুলবুলের মরদেহ সেখান থেকে রংপুরে আনা হবে বলে জানান পরিবারের লোকজন।

ঢাকায় বুলবুলের ঠিকাদারি কাজ দেখতেন তার ছোট ভাই আহমেদ রাহি বকুল। গত মাসে বুলবুল রংপুরে এসে ঘুরে গেছেন। এর কিছু দিন পর ছোট ভাই বকুল রংপুরে আসেন। হঠাৎ কী কারণে বা কেন দুর্বৃত্তরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তা বুঝে উঠতে পারছেন না বুলবুলের মা-বোনসহ প্রতিবেশীরা।

তার ছোট বোন লাভলী সামাদ বলেন, আমার এলাকার একজন মিস্ত্রি আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় থাকেন। উনার স্ত্রী সকালে এসে আমাদেরকে ভাইয়ের অসুস্থতার কথা বললেও পরে আমার ছোট ভাই বকুলের কাছে বুলবুল ভাইয়ের মৃত্যুর বিষয়টি জানায়। তবে কীভাবে কী ঘটনা ঘটেছে, কেন এমনটা হয়েছে, এসবের কিছুই আমরা জানি না। যদি সন্ত্রাসীরা আমার ভাইকে হত্যা করে থাকে, তাহলে আপনারা মিডিয়ায় তুলে ধরুন, তাদেরকে বিচারের আওতায় আনার ব্যবস্থা করুন।  

কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, এটি পরিকল্পিত ঘটনা হতে পারে। এর সঙ্গে পরিচিতদের কেউ জড়িত থাকতে পারে। তা না হলে এতো সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার খবর পেল কীভাবে? আমার ভাই আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। ঢাকায় দন্ত চিকিৎসা পেশার পাশাপাশি ঠিকাদারি করতেন। ঠিকাদারি কাজে তার নোয়াখালী যাওয়ার কথা ছিল। এখন ভাই নেই। ভাবি এবং দুই শিশু সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরা কীভাবে দিন পাড় পার করবেন।  সরকারের কাছে অনুরোধ অপরাধীদের গ্রেপ্তার করুন। মানুষ যাতে যে কোনো সময় নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারে তা নিশ্চিত করুন।

মেয়ের সঙ্গে ডা. বুলবুল

স্থানীয় কাউন্সিলর গাফফার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সকালে তার মৃত্যুর খবরটি জানতে পেরেছি। তবে এখনো মরদেহ রংপুরে পৌঁছায়নি। বিষয়টি খুবই মর্মান্তিক। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কে বা কারা জড়িত, তা উদঘাটন করা জরুরি।

তিনি আরও বলেন, ছেলে হিসেবে ডা. বুলবুল খুব ভালো ছিলেন। তিনি বিএনপিপন্থী মানুষ। ঢাকায় বিএনপি নেতা হাবিব উন-নবী খান সোহেলের সঙ্গে তার ওঠাবসা ছিল। এখন তার হত্যাকাণ্ডের ঘটনার নেপথ্যে জড়িতরা ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে নাকি অন্য কোনো কারণে তাকে ছুরিকাঘাত করেছে, সেটা প্রশাসনকে বের করতে হবে। আমরা চাই অপরাধী যেই হোক, তার বিচার হোক।

ডা. আহমেদ মাহি বুলবুলের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন। চাকরি করাকালীন ১৯৯৯ সালে তিনি মারা যান। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন বুলবুল। ১৯৯৭ সালে রংপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও রংপুর ক্যান্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর তিনি ঢাকায় চলে যান। সেখানে মগবাজারে একটি বেসরকারি ডেন্টাল কলেজে পড়াশোনা করেন। তিনি মগবাজারে রংপুর ডেন্টাল নামে একটি চেম্বার খুলে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন। সেখানে তিনি দরিদ্র ও নিম্নবিত্তদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতেন। শুধু স্বাবলম্বীদের কাছ থেকে ফি নিতেন। এর বাইরে তিনি কিছু ঠিকাদারি কাজ করতেন। 

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর