মেলা থেকে এলাকার জামাইরা মাছ কিনে শ্বশুরবাড়িতে যায়

হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী কুড়িখাই মেলা। বছরের প্রতি মাঘ মাসের শেষ সোমবার থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী সাতদিন চলে এই মেলা। আধ্যাত্মিক সাধক শাহ শামসুদ্দিন বুখারি (র.) এর মাজারে ওরস উপলক্ষে বসে এই মেলা। 

এ উপলক্ষে বসেছে নানা প্রজাতির মাছের বিরাট মেলা। মেলায় কোনো কোনো মাছ দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত মূল্যেও বিক্রি হয়। মাছ বিক্রেতারা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জের হাওর ও নদী থেকে এক সপ্তাহ পূর্ব থেকে এসব বড় বড় মাছ সংগ্রহ করে মেলায় বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন।

এ মেলার হাটে বোয়াল, চিতল, বাঘাইড়, রুই, কাতলা, সিলভার কার্পস, পাঙ্গাশ, মাগুরসহ নানা ধরনের অন্তত চার শতাধিক মাছের দোকান বসে। এসব মাছের ক্রেতারা হচ্ছেন, বিভিন্ন স্থানে বিয়ে দেওয়া কটিয়াদী উপজেলার মেয়েদের স্বামী।

এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধনাঢ্য ব্যক্তিসহ সর্বস্তরের লোকজন এই মেলা থেকে মাছ কিনে নিয়ে যান। মেলায় হাজারও দর্শক আসেন বড় বড় মাছ দেখতে।

এই প্রাণের মেলায় জেলার অধিবাসীদের পাশাপাশি দেশের দূর-দূরান্ত থেকে লাখো দর্শনার্থী, আগন্তুক ও আধ্যাত্মিক সাধক-ফকির এমনকি বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীদের সমাবেশ ঘটে।

মেলার প্রাঙ্গণজুড়ে শিশু-কিশোরদের জন্য রয়েছে বিনোদনমূলক-ব্যবস্থা

মাজারসংলগ্ন বিশাল প্রাঙ্গণজুড়ে শিশু-কিশোরদের নানারকম বিনোদনমূলক বাহন— খেলনা, মাটি, বাঁশ-বেত, কুটিরশিল্পসামগ্রী ও বাহারি মুখরোচক ঐতিহ্যবাহী খাদ্য সম্ভারের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। 

এলাকায় প্রবাদ রয়েছে, কুড়িখাই মেলার মাছ খেলে সকল মুসিবত দূর হয়। মেলার পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে প্রতি বাড়িতে মেলা উপলক্ষে জামাই ও আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াতের রীতি রয়েছে।

শিশু-কিশোরদের মনোরঞ্জনে বিশাল মেলার আয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখানে সাধক-ফকির ও বাউলদের গান-বাজনার আসর বসলেও শেষ পর্যন্ত জামাই-বউয়ের মাছের মেলা সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়। এই আনন্দ আয়োজনে অংশ নিতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ। স্থানীয় প্রশাসনও মনে করে এ বিচিত্র আয়োজনের মেলা বাঙালি সংস্কৃতির নিদর্শনের অপূর্ব স্মারক।

জনশ্রুতি আছে, ১২ আওলিয়ার সঙ্গে ৮০০ বছরেরও আগে ইসলামধর্ম প্রচার করতে আসা আধ্যাত্মিক সাধক শাহ শামসুদ্দিন বুখারির (র.) দেহ ত্যাগের পর গড়ে ওঠা মাজারের ওরসকে কেন্দ্র করে এ প্রাণের মেলার গোড়াপত্তন হয়। করোনাভাইরাস উপেক্ষা করে প্রতি বছরের মতোই সোমবার (৮ ফেব্রুয়ারি) থেকে বসেছে ওই কুড়িখাই মেলা।

অপরদিকে, মেলার এক প্রান্তে বসেছে সাধক-ফকির-বাউদের গান-বাজনা ও গঞ্জিকার আসর। সুষ্ঠু পৃষ্ঠপোষকতা ও উপযুক্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কুড়িখাইয়ের এ প্রাণের মেলা দিনে দিনে আরও সমৃদ্ধি লাভ করবে এমটিই প্রত্যাশা সকলের।

মেলায় আসা শিশু আকাশ বলেন, ‘মেলা উপলক্ষে আমরা মানিকগঞ্জ থেকে নানার বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। আমি আমার মামা ও নানার সঙ্গে মেলাতে ঘুরতে এসেছি। মেলা থেকে আমার মনের মতো খেলনা কিনব। আমি আগামী বছর আবারও মেলাতে আসব।’

এলাকার সংস্কৃতিকর্মী রাজিব কুমার সরকার পলাশ বলেন, ‘জাতি-ধর্ম নির্বিশেষ মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে মেলায় এক উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। মেলার আরেকটি ঐতিহ্য হল এখানে বউমেলা হয়। সেই মেলায় এই এলাকার মেয়েরা স্বামীর বাড়িতে থেকে বাবার বাড়িতে স্বামীসহ নাইয়র আসে। আর মেলা থেকে এলাকার জামাইরা মাছ কিনে নিয়ে যায় শ্বশুরবাড়িতে।

মাছ ব্যবসায়ী আসাদুল বলেন, বড় বড় মাছ নিয়ে মেলায় এসেছি। মাছ বিক্রি শুরু হয়ে গেছে। এলাকার জামাইরা কে কার চেয়ে বড় মাছ কিনবে চলে সেই প্রতিযোগিতা চলে। আমি একটি বোয়াল মাছ ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি।

মেলা কমিটির সম্পাদক মঈনুজ্জামান অপু জানান, শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এ মেলা চলে আসছে। এ মেলার সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হচ্ছে মাছের মেলা।

এসকে রাসেল/এমএসআর