দিনাজপুরের নদ-নদী ও খাল-বিলে পানি না থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন কৃষকরা। গভীর নলকূপেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত পানি। প্রয়োজনের সময় পানির অভাবে ব্যাহত হচ্ছে বোরো ধান চাষ। ফেটে চৌচির হচ্ছে ফসলি জমি। এতে দিন দিন বাড়ছে বোরো উৎপাদন খরচ।

সরেজমিনে চিরিরবন্দর উপজেলার চিরির নদী এলাকায় দেখা যায়, নদীর পানি ধরে রাখতে সেখানে রাবার ড্যাম ফোলানো অবস্থায় রাখা রয়েছে। কিন্তু রাবার ড্যামের দুপাশে নদীতে কোনো পানি নেই। বর্তমানে এই নদীর পানিনির্ভর কৃষকরা সেচের জন্য পানি না পেয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন।

এদিকে আবাদ রক্ষায় নতুন করে নলকূপ স্থাপন ও ডিজেলচালিত সেচে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। তারা বলেছেন, অহেতুক রাবার ড্যাম ফুলিয়ে রেখেছে এলজিইডি কর্তৃপক্ষ। অন্য বছরগুলোয় ডিজেলচালিত সেচপাম্প ও বরেন্দ্র নলকূপ দিয়ে চিরির নদী থেকে পানি মিললেও এ বছর তা পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ এ বছর নদীতে পানি না থাকায় চাষাবাদ নিয়ে চিন্তিত তারা।

পানির সুবিধাবঞ্চিত কৃষকদের অভিযোগ, আগে আত্রাই নদ থেকে কাঁকড়া নদীসহ অন্যান্য ছোট-বড় নদ-নদী ও খালে পানিপ্রবাহ হলেও এবার আত্রাই খননের পর পানি মিলছে না। কারণ, হিসেবে দাবি করা হচ্ছে, আত্রই নদী খনন করায় গভীরতা বেড়ে (নিচু) আগের মতো এখন পানিপ্রবাহ নেই। কারণ অন্যান্য ছোট-বড় নদ-নদী ও খালে গভীরতা না থাকাসহ প্রবাহ পথ (উঁচু) রুদ্ধ হয়েছে। বরং দীর্ঘ সময় ধরে কাঁকড়াসহ অন্য নদ-নদীগুলো খনন না করায় বালুর চর ও পলি মাটি জমে ভরাট হয়েছে। এ কারণে শুষ্ক মৌসুমে পানি পাচ্ছেন না তারা।

বর্তমানে পানির জন্য জমির পাশে নলকূপ স্থাপনসহ ডিজেলচালিত সেচে নির্ভর হতে হচ্ছে কৃষকদের। আর এতে গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে তাদের। কৃষকদের দাবি, এক বিঘা জমিতে ধান উৎপাদনে এ বছর খরচ বেড়েছে পাঁচ হাজার টাকা।

চিরিরবন্দরের দক্ষিণ সুকদেবপুর গ্রামের কৃষক একরামুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, যুগ যুগ ধরে চিরির পানি দিয়ে ইরি ও বোরোসহ বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ করে আসছি। কিন্তু এখন নদীতে পানি নেই। পানির অভাবে ইরি ও বোরোতে খরচ বেড়েছে। এখন বিঘায় প্রায় পাঁচ হাজার টাকার মতো বাড়তি খরচ হচ্ছে। চাষাবাদ না করলে আমাদের সংসার চলবে না। এ জন্য খরচ বাড়লেও বাধ্য হয়ে চাষ করতে হচ্ছে। কিন্তু ধানের বাজার না থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।

একই উপজেলার পূর্বসাইতাড়া গ্রামের কৃষক সাইমুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, হারা কৃষকরা পানি বাগরে কত কষ্ট করি ধান নাগাছি, সেটা হারা জানি। জমিতে বিছন লাগার আগ মুহূর্তে কাঁকড়া নদীর পানি শুকি গেইছে। কষ্ট করে ধান নাগাছি। ধান না নাগালে হারা কী খামো? এই জন্য বাড়ির গরু বিক্রি করি নতুন করে পানির বডিং করি ধান লাগাইতে হয়েছে। কৃষকের কষ্ট কেহ দেহে না।

উপজেলার খোচনা গ্রামের কৃষক মুর্তাজা আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আখিরের ডারার পানি দিয়ে প্রতিবছর ১০ একর জমিতে বোরো ধান লাগাই। নদীতে পানি না থাকায় বরেন্দ্র বন্ধ করে রাখা হয়েছে। নতুন করে পানি তোলার জন্য বডিং করা হয়েছে। এখন ধান বেরানোর সময় হয়েছে। পানি না থাকায় জমি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। আগে নদী থেকে পানি তুলে এক বিঘা জমিতে খরচ হতো ৭০০ টাকা। আর এখন বডিং করে পানি তুলতে খরচ ২৫০০ টাকা। কীটনাশক ও সারের দাম বেড়েছে। ডিজেলসহ সবকিছুর দাম বেশি। কিন্তু হারা ধানের দাম টিকমত পাই না।

কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে কৃষি বিভাগ বলছে, প্রাকৃতিক কারণে এখন নদীগুলোতে আগের মতো পানি থাকছে না। একই অবস্থা ছোট নালা ও খাল-বিলের। পানি শুকিয়ে যাওয়ায় কৃষিকাজে ব্যাঘাত ঘটছে। ছোট-বড় নদ-নদীগুলো খননের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। খনন শেষ হলে নদী-নালা ও খালে শুকনো মৌসুমেও পানি পাওয়া যাবে।

এ ব্যাপারে চিরিরবন্দর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জোহরা সুলতানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, নদী-নালা, খাল-বিলে পানি নেই। পানি না থাকায় কৃষকরা নতুন করে বডিং করে জমিতে পানি দিচ্ছেন। এতে তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক। তবে এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধানের বাম্পার ফলন আশা করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আত্রাই নদ খননের কারণে এর সঙ্গে সংযুক্ত অন্য সব নদী-নালা ও খালে পানিপ্রবাহ হচ্ছে না। কারণ খননের কারণে আত্রাই নদ নিচু হয়ে গেছে। বাকি নদীগুলোয় এখানকার পানি যেতে পারছে না। তবে ধীরে ধীরে সব নদ-নদী ও খাল খনন শেষ হলে আগের মতো কৃষকরা নদীর পানি পাবেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ জেলায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ লাখ ৭৪ হাজার ২২০ হেক্টর জমিতে ৭ লাখ ২৯ হাজার ২৬৩ মেট্রিক টন বোরো ধান উৎপাদিত হয়েছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ লাখ ৭১ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত হয় ৭ লাখ ৩১ হাজার ১৭৩ মেট্রিক টন। গেল অর্থবছর ২০২০-২১ মৌসুমে ১ লাখ ৭১ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) খালেদুর রহমান বলেন, গত বছরের চেয়ে এবার উৎপাদন ও লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে জেলায় ১ লাখ ৭২ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৫০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চিরিরবন্দর উপজেলায় ১৯ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে।

এনএ