বাগেরহাটে প্রবহমান হোজির নদী দখল করে মাছ চাষ করার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। সেতুর নিচে আড়াআড়ি বাঁধ দেওয়াসহ আরও দুটি স্থানে বাঁধ দিয়ে আট কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ছয় কিলোমিটার নদী দখলে নিয়ে মাছ চাষ করছেন ২০ থেকে ২২ নেতা-কর্মী।

সদর উপজেলার ডেমা ইউনিয়নে অবস্থিত নদীটি সম্প্রতি খনন করা হয়েছে। কিন্তু দখলমুক্ত না হওয়ায় সরকারি ৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকার কোনো সুফল পাচ্ছেন না স্থানীয়রা।

স্থানীয়ভাবে জানা যায়, ডেমা ইউনিয়েনের ৫ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি রবিউল ইসলাম ৫ নং ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য ও ডেমা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ফরিদ মোল্লা, ৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নকিব হাই, ৫ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ফরহাদ শেখ, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য সাইফুল ফকিরসহ স্থানীয় ২০ থেকে ২২ জন এর সঙ্গে জড়িত।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, দেশের ৬৪টি জেলায় অভ্যন্তরীণ ছোট নদী, খাল ও জলাশয় খনন প্রকল্পের আওতায় ডেমা ইউনিয়নের হোজির নদীটি খনন করা হয়। ৮ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদীটির খননের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।

সরেজমিনে দেখা যায়, ডেমা ইউনিয়নের হোজির সেতু থেকে দক্ষিণ দিকে খেগরাঘাট পর্যন্ত তিন কিলোমিটার এবং সেতু থেকে উত্তর দিকে বৈটেঘাটা পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। এতে নদীর জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। আবার সেতুর নিচে দেওয়া বাঁধের ওপর খুপরি ঘর নির্মাণ করে সেখানে মাছের খাবারসহ বিভিন্ন মালামাল রাখা রয়েছে। কয়েকটি জায়গায় জাল দিয়েও মাছ চাষ করা হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৭ সালে একবার বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা হয়েছিল। পরে উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে তা উচ্ছেদ করে। এখন আবার আওয়ামী লীগের নেতাদের দখলে চলে যায় নদীর অস্তিত্ব।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন জানান, বিএনপি বা আওয়ামী লীগ যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের লোকজনই প্রভাব খাটিয়ে নদীতে মাছ চাষ করে। নদীতে বাঁধ দেওয়ার কারণে একদিনে নদী ছোট হচ্ছে, অপরদিকে স্থানীয় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডেমা ইউনিয়েনের ৫ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি রবিউল ইসলাম বলেন, তিন যুগের বেশি সময় ধরে এই নদীতে মাছ চাষ করা হচ্ছে। যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারাই এই নদী ভোগ করে। এ বছর আমরা প্রায় ৭ লাখ টাকার গলদা, বাগদা, রুই ও কাতলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ছেড়েছি। নদী দখল অবৈধ কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রশাসন নিষেধ করলে আমরা ছেড়ে দিব। সমস্যা নেই তো।

নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বাগেরহাটের আহ্বায়ক মো. নূর আলম শেখ বলেন, নদ-নদী রক্ষার বিষয়ে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট রায় রয়েছে। প্রতিটি জেলায় দখলদারদের তালিকা করার নির্দেশনাও রয়েছে ওই রায়ে। দখলদারদের তালিকা প্রস্তুত করে অতিদ্রুত একে দখলমুক্ত করার দাবি জানান তিনি।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, দখল-দূষণের ফলে নদ-নদীর গভীরতা কমে যায়। ফলে নদীতে বসবাস করা জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব হারানো আশঙ্কা থাকে। নদী সরু ও গভীরতা কমে যাওয়ায় আশপাশের এলাকা বর্ষাকাল ছাড়াও জোয়ারে প্লাবিত হতে পারে।

সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মুছাব্বেরুল ইসলাম বলেন, ডেমা ইউনিয়নের একটি নদী দখল করে মাছ চাষের বিষয়টি আমরা জেনেছি। বাঁধ অপসারণ করে মাছ চাষ না করার জন্য ইউপি চেয়ারম্যানের মাধ্যমে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অতিসত্বর অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ডেমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনি মল্লিক বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে দখলদারদের বিরুদ্ধে এলাকায় মাইকিং করে সতর্ক করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ডেমা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার যেসব নদী-খাল দখলে ছিল, তার অর্ধেকের বেশি দখলমুক্ত করা হয়েছে। আশা করি সবার সহযোগিতায় এখনো দখলে থাকা নদী-খাল অবমুক্ত করতে পারব।

তানজীম আহমেদ/এনএ