বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার চাকশ্রী গ্রামের বাসিন্দা শেখ আবু তালেব। সরকারি প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজের স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। দিনের বেলায় বাগেরহাট শহরের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেন। রাতে বাড়িতে ফিরে পড়তে বসেন। তবে বেশ কিছু দিন ধরে বিদ্যুতের আলোয় নয়, তাকে পড়তে হচ্ছে মোমবাতির মৃদু আলোতে। কম আলোয় পড়তে চোখের ওপর চাপ বাড়ার পাশাপাশি মাথার যন্ত্রণায়ও আক্রান্ত হচ্ছেন বলে দাবি তার। 

বিদ্যুৎ অফিসের প্রদত্ত শিডিউল অনুযায়ী দিন-রাতে দুই ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কথা থাকলেও অন্তত ৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না বলে জানান শেখ আবু তালেব। একই কথা জানান স্থানীয় বেশ কয়েকজন ব্যক্তি। 

শুধু রামপাল নয়, বাগেরহাটের অন্য ৮টি উপজেলাতেই একই চিত্র দেখা গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে রয়েছেন শরণখোলা উপজেলার মানুষ। এই উপজেলায় গড়ে প্রতিদিন ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা লোডশেডিং হয়। পার্শ্ববর্তী উপজেলা মোরেলগঞ্জে ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না।

গত ২৪ ঘণ্টার হিসেবে রোববার বিকেল ৪টা থেকে সোমবার বিকেল ৪টা) বাগেরহাটের ৯টি উপজেলার মধ্যে গড়ে সদর উপজেলায় বিদ্যুৎ ছিল না চার ঘণ্টা, কচুয়ায় সাড়ে চার ঘণ্টা, মোরেলগঞ্জে ১০ ঘণ্টা, শরণখোলায় চৌদ্দ ঘণ্টা, ফকিরহাটে সাড়ে তিন ঘণ্টা, মোল্লাহাটে চার ঘণ্টা, চিতলমারী সাত ঘণ্টা, রামপালে ছয় ঘণ্টা ও মোংলায় তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না বলে জানা যায়। 

পল্লী বিদ্যুৎ অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকদের চাহিদা পিক আওয়ারে ৭৫ মেগাওয়াট থাকলেও বরাদ্দ থাকছে ৫২ থেকে ৫৩ মেগাওয়াট। অপরদিকে অফপিকে ৫০ থেকে ৫২ মেগাওয়াট চাহিদা থাকলেও বরাদ্দ আসে ৩৫ থেকে ৩৬ মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎ অফিসের তালিকা অনুযায়ী প্রতি উপজেলাতেই এলাকা অনুযায়ী সময় ভেদে লোডশেডিং হওয়ার কথা দুই থেকে তিন ঘণ্টা। কিন্ত কয়েক গুণ বেশি লোডশেডিং হওয়ায় দুর্ভোগে নাকাল জনজীবন।

শরণখোলার রায়েন্দা হাট বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান বাবুল বলেন, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী রাত ৮টার মধ্যে আমরা দোকান বন্ধ করি। কিন্তু তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়েছে। সারারাত বিদ্যুৎ না থাকার কারণে গরমে আমাদের জীবন অতিষ্ঠ। সন্তানেরা না পড়তে পারে, না ঘুমাতে পারে।  

লোডশেডিংয়ে ব্যবসার বেশ ক্ষতি হচ্ছে জানিয়ে একটি বরফ কলের মালিক মো. গোলাম মোস্তফা তালুকদার বলেন, উৎপাদিত বরফ নিয়ে জেলেরা সাগরে যায়। বর্তমানে দিনে যতটুকু বরফ জমে রাতে বিদ্যুৎ না থাকায় তা আবার গলে যায়। বিদ্যুৎ ছাড়া তো আমাদের বিকল্প উপায়ও নেই। কয়েকদিন ধরে বিক্রি বন্ধই বলা যায়। 

আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন বাগেরহাটের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরাও। লোডশেডিং শিডিউলের সঙ্গে বিদ্যুৎ যাওয়ার কোনো মিল নেই বলে জানান একাধিক ব্যবসায়ী।

অপরদিকে গ্রামে বেশি লোডশেডিং হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছেন ব্যাটারিচালিত যানের (রিকশা, ভ্যান, ইজিবাইক) চালকরা। সাধারণত দিনে গাড়ি চালিয়ে রাতে চার্জ দেন তারা। কিন্তু রাতে দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় ঠিকমতো চার্জ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না যানবাহনগুলোতে। দিনে বের করলেও খুব বেশি সময় চালাতে পারছেন না চালকরা। ফলে দৈনন্দিন জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে তাদের। 

এ বিষয়ে সদর উপজেলার কাশিমপুর এলাকার ইজিবাইক চালক আফতাব শেখ বলেন, একদিকে সব কিছুর দাম হু হু করে বাড়ছে, অপরদিকে ঠিকমতো গাড়িও চালাতে পারছি না। যেখানে সারারাত চার্জ দেওয়া প্রয়োজন, সেখানে চার্জ হয় দুই-তিন ঘণ্টা। বাকি সময় বিদ্যুৎ থাকে না। ফলে দিনে গাড়ি বের করার অল্প সময় পরেই চার্জ ফুরিয়ে যায়। বিপদ সব গরিবদের। 

বাগেরহাট পল্লি বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার মুহাম্মদ নুরুল হোসাইন বলেন, লোডশেডিংয়ের একটা শিডিউল আছে। কিন্তু জাতীয় গ্রিড থেকে যদি বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন শিডিউল নিশ্চিত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। 

তানজীম আহমেদ/আরএআর