বিলুপ্তির পথে পুতুল নাচ, পরিবার নিয়ে কষ্টে আছেন শিল্পীরা
গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাচ আজ বিলুপ্তির পথে। এমনকি এর সঙ্গে জড়িত কলা-কুশলীরাও পড়েছেন চরম বিপাকে। পুতুল নাচকে ঘিরে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষগুলো অর্থের অভাবে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।
কথা হয় কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার সীমান্তঘেঁষা দক্ষিণ পাথরডুবি গ্রামের মনিকা পুতুল নাচ অ্যান্ড থিয়েটারের মালিক মো. মকবুল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আজ থেকে ৪০ বছর আগে আমি যাত্রাপালায় কাজ করতাম। সেই সময় আমাদের ভুরুঙ্গামারীতে ভারতের দিনহাটা থেকে মা কালি পুতুল নাচ নামে একটি টিম আসে। যাত্রাপালা করতে গিয়ে সেখানে পরিচয় হয় ‘মা কালি পুতুল নাচ’ এর মালিক শ্রী মুরালী বর্মনের সঙ্গে। যাত্রাপালার পাশাপাশি পুতুল নাচ নিয়ে টিম করার ইচ্ছে প্রকাশ করলে তিনি ৮০ হাজার টাকায় পুরো পুতুল সেট আমার কাছে বিক্রি করে দেন।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, ৯ জন সদস্য নিয়ে শুরু হয় প্রশিক্ষণ পর্ব। ভারতের কুচবিহার, শিলিগুড়ি, দিনহাটা থেকে পুতুল নাচের মাস্টার এনে টানা ৬ মাস প্রশিক্ষণ নিই। ১৯৮৪ সালের দিকে দিনহাটা থেকে আসা মাস্টার শ্যামল কুমার বর্মনের হাত ধরে মা কালি পুতুল নাচ নাম বদলে মনিকা পুতুল নাচ অ্যান্ড থিয়েটার নাম দিয়ে যাত্রা শুরু করি। প্রথম দিকে শুধু কুড়িগ্রাম জেলার ভেতরে অনুষ্ঠান শুরু করলেও ১৯৮৭ সালে সরকারি নিবন্ধন পাওয়ার পর বাইরের জেলাতে অনুষ্ঠান শুরু করি। পরবর্তীতে কুড়িগ্রাম, রংপুর, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, নীলফামারীসহ ঢাকা কেন্দ্রীয় শিল্পকলা একাডেমিতে শো করে আসছি। শিল্পকলা থেকে পুরস্কার পেয়েছি তবে যোগাযোগের অভাবে মনিকা পুতুল নাচ অ্যান্ড থিয়েটার বিদেশে শো করতে পারিনি।
বিজ্ঞাপন
তিনি আরও বলেন, প্রশাসন আমাদের প্রোগ্রাম করার অনুমতি দেয় না। কারণ বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়, পুতুল নাচের নামে বিভিন্ন ব্যক্তি অশ্লীল নাচ-গান করায়। সরকারি কোনো সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া এভাবে টিকে থাকা যায় না। তবে আমি যতদিন বেঁচে আছি এই পুতুলের সঙ্গেই জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাই।
মনিকা পুতুল নাচ অ্যান্ড থিয়েটারের সভাপতি ভানু বর্মন বলেন, আমি ১৯৮৪ সাল থেকে এই দলে কাজ করি। এ পর্যন্ত ২১টি যাত্রাপালায় গান, বাজনা, সুর, কণ্ঠ ও অভিনয় করেছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- এক ফুল দুই মালি, কাশেম মালার প্রেম, সতী রূপভান, রাম বনবাস, দানবীর রাজা হরিশ্চন্দ্র, রাবন বধ, মহাসতী সাবেত্রী সত্যবান, সাগর ভাষা ইত্যাদি। তবে প্রায় ২০ বছর ধরে পুতুল নাচ বন্ধ। ফলে আমাদের উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা খুব কষ্টে আছি।
পালাকার আবুল হোসেন বলেন, পুতুল নাচ বন্ধ হয়ে গেছে। আগের মত আমাদের ডাক আসে না। বছরে সরকারিভাবে দুই একটি অনুষ্ঠানে ডাক পড়ে। সে সময় ৪-৫টা শোয়ের টাকা পাই। আর সারা বছর দিনমজুর করে সংসার চলে। সরকার যদি সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে আবার পুতুল নাচ অনুষ্ঠানের অনুমতি দিত, তাহলে এ পেশায় জড়িত থাকা মানুষগুলোর দুঃখ ঘুচতো।
তবলা বাদক স্বপন বর্মন বলেন, আমি এ পেশার সঙ্গে ৩০ বছর ধরে জড়িত। আগে পুতুল নাচ ভালো চলতো।মোবাইলের যুগে এখন আর মানুষ দেখে না। ফলে শো চালাতে পারছি না, আয় রোজগার কমে গেছে। আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি। সরকার আমাদের কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করছেন না। আমরা পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে আছি।
মূক নাচ শিল্পী হোসেন আলীর স্ত্রী নুরবানু বলেন, আমার স্বামী ৪০ বছর ধরে পুতুল নাচ দেখাতেন। প্রায় ২০ বছর ধরে পুতুল নাচ বন্ধ। এখন আগের মতো আয় রোজগার নেই। বাচ্চাদের ভরণপোষণ নিয়ে খুব কষ্টে আছি।
সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউনিয়নের মিলপাড়া গ্রামের বৃদ্ধ মোসলেম উদ্দিন বলেন, গত ২০-২৫ বছর ধরে পুতুল নাচের দেখা নেই। আগে তো প্রতি বছর আমাদের এখানে শীতকালে পুতুল নাচ হতো। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পুতুল নাচ চালাতো তারা। এখন পুতুল নাচের শিল্পীরা আছে, না নাই আল্লাহ জানেন।
কুড়িগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার মো. আলমগীর কবির বলেন, মনিকা পুতুল নাচ অ্যান্ড থিয়েটার দলের দুজন সরকারিভাবে ভাতার আওতাধীন হয়েছেন। বাকিদের পর্যায়ক্রমে আনা হবে। এছাড়া ওই দলটির জন্য বাৎসরিক ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আসলে দেওয়া হয়। সরকার বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাচের ব্যাপারে উৎসাহী। পুতুল নাচ প্রদর্শনীর বিষয়ে কোনো বাধা নেই বলে জানান তিনি।
জুয়েল রানা/এসপি