পাবনার ঈশ্বরদীর আলোচিত সেই ৩৭ ঋণখেলাপি কৃষকদের মধ্যে কয়েকজন ঋণের প্রায় পুরো টাকা পরিশোধের পরও মাত্র ৪০০ থেকে ৯০০ টাকা বকেয়ার জন্য গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বলে জানা গেছে। অনেকে যা ঋণ নিয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি টাকা দিয়েও মামলার আসামি হয়েছেন, দুই দিন কারাগারে থেকেছেন।

সোমবার (৫ ডিসেম্বর) দুপুর ১২টার দিকে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক (পরিদর্শন ও আইন) মো. আহসানুল গণির নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি উপজেলার ভাড়ইমারি গ্রামে গিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে এসব কথা জানতে পারেন। তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- উপব্যবস্থাপক (পরিদর্শন ও আইন) আব্দুর রাজ্জাক ও সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রকল্প ঋণ) আমিনুল ইসলাম রাজীব।

তদন্ত দলের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ঋণের দায়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়া ৩৭ কৃষকের মধ্যে আতিয়ার রহমান ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সুদসহ ৪৯ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন। তার বকেয়া রয়েছে মাত্র ৪৩৩ টাকা। এরপরও তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

মোছা. রহিমা বেগম নামের এক নারী ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ৪৫ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন। তার বকেয়া রয়েছে মাত্র ৯০০ টাকা। তার নামেও মামলা হয়েছে। মজনু প্রামাণিক নামের অপর একজন ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ৫৫ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন।

সোমবার দুপুর ১২টার দিকে তদন্ত কমিটির সদস্যরা ভাড়ইমারি গ্রামে পৌঁছান। তবে কৃষকদের কেউ নিজেদের ঘরে নেই, সবাই মাঠে কাজে ব্যস্ত। তদন্ত দল পৌঁছানোর খবরে কৃষকেরা মাঠ থেকে আসতে থাকেন। তদন্ত দলের সদস্যরা কৃষকদের কাছে ঋণ পরিষদের তথ্য জানতে চান। কিন্তু কৃষকেরা ঋণ পরিশোধের তেমন কোনো কাগজ দেখাতে পারেননি। তবে তারা মুখে মুখে পরিশোধের হিসাব ও তারিখ জানান। কৃষকদের মনে রাখা তথ্য ব্যাংকের স্টেটমেন্টের সঙ্গে মিলে যায়। এ সময় কয়েকজন নিজেদের সামান্য বকেয়ার কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা তদন্ত দলের কাছে প্রশ্ন তোলেন, টাকা পরিশোধ করে কেন জেল খাটতে হলো? কৃষকদের এই প্রশ্নে তদন্ত দলের সদস্যরা চুপ হয়ে যান।

৪৩৩ টাকা বকেয়া থাকা আতিয়ার রহমান বলেন, ‘আমাদের কি মানসুম্মান নাই? ৪০০ টাহার জন্যি জেল খাটা লাগল। হগলে মনে করল, কত টেহা জিনি মারে খাইছি। গেরামে মুখ দেহাবের পারিনে।’

মজনু প্রামাণিক বলেন, ‘৪০ হাজারে ১৫ হাজার সুদ দিলেম। তারপরেও জেলে গেলেম। ইডা কুন নিয়ম, বুঝলেম না। আমাগের এই হয়রানির বিচার চাই।’

এ প্রসঙ্গে তদন্ত দলের প্রধান বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক (পরিদর্শন ও আইন) মো. আহসানুল গণি বলেন, মূলত গ্রুপ ঋণের কারণেই সবার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এখানে ব্যাংকের কিছু করার ছিল না। তবে যাদের কম টাকা বকেয়া, তাদের বাদ দেওয়া যেত। এটা হয়তো ভুলবশত হয়েছে। পরবর্তীতে বিষয়টি দেখা হবে। ১০ লাখ টাকা পরিশোধের পরও এত বকেয়া কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ১৫ শতাংশ সুদ হারে ঋণ দেওয়া হয়েছিল। কিছু কৃষক টাকা পরিশোধ না করায় চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বেড়ে গেছে।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে ঈশ্বরদী উপজেলার ভাড়ইমারি গ্রামের ৪০ জন কৃষক দলগত ঋণ হিসেবে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক থেকে ১৬ লাখ টাকা গ্রহণ করেন। এর মধ্যে কেউ ২৫ হাজার, কেউ ৪০ হাজার টাকা করে ঋণ পান। দীর্ঘদিনেও সেই ঋণ ও সুদের টাকা পরিশোধ না করায় ২০২১ সালে ৩৭ জন কৃষকের নামে মামলা করে ব্যাংকটি। সম্প্রতি আদালত তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে গত ২৫ নভেম্বর ১২ জন কৃষককে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায় পুলিশ।

বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। পরে গত ২৭ নভেম্বর পাবনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-২ এর ভারপ্রাপ্ত বিচারক শামসুজ্জামান গ্রেপ্তার থাকা ১২ জনসহ ৩৭ জন কৃষকের জামিন মঞ্জুর করেন। পরে ২৯ নভেম্বর ৩৭ কৃষক তাদের সুদসহ ঋণের বাকি টাকা ও মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান। ঈশ্বরদী উপজেলার ভাড়ইমারি উত্তরপাড়া সবজি চাষি সমবায় সমিতি লিমিটেডের সদস্য বিলকিস নাহার কৃষকদের পক্ষে এ সংক্রান্ত আবেদন করেন।

রাকিব হাসনাত/এমজেইউ