খেজুর রসের খোঁজে রাজশাহী থেকে ফরিদপুরে, ৩ লাখ টাকা আয়ের আশা
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চন্দ্রীপুরের বালুখালিয়া গ্রামের দুই প্রতিবেশী রায়হান শেখ (২৪) ও আখলাচুর মোল্লা (৩৯)। শীত মৌসুমে এলাকায় কোনো কাজ না থাকায় এসেছেন খেজুর গুড়ের জন্য বিখ্যাত ফরিদপুর জেলায়। গত অক্টোবর মাসের শেষের দিকে তারা এখানে এসেছেন। থাকবেন আরও চারমাস। এখানে খেজুর গাছ কেটে রস আহরণ করে গুড় বানিয়ে তা বিক্রি করে দেড় লাখ থেকে তিন লাখ টাকা আয় করবেন বলে আশা তাদের।
শনিবার (১০ ডিসেম্বর) দুপুর ১২টার দিকে ফরিদপুর সদর উপজেলার কানাইপুর ইউনিয়নের রনকাইল গ্রামে একটি মেহগনি গাছের বাগানে দেখা যায় দুই গাছির প্রস্তুতিপর্ব। একজন খেজুর রস রাখার হাড়িতে চুন দিচ্ছেন, আরেকজনকে দেখা গেছে খেজুরগাছ কাটার দা'তে ধার দিচ্ছেন। কাছে যেতেই কথা হয় তাদের সঙ্গে।
বিজ্ঞাপন
এত দূর থেকে এই ফরিদপুরে খেজুরগাছ কাটতে কেন এসেছেন? জানতে চাইলে আখলাচুর ও রায়হান দুজনেই হেসে বলেন, ফরিদপুর জেলা তো খেজুর গুড়ের জন্য বিখ্যাত জানেন না? এই জায়গার গুড়ের সুনাম তো ভারতের কলকাতা পর্যন্তও আছে। এই জায়গার গুড়ের অনেক চাহিদা সারাদেশে তাই এখানে এসেছি।
তাদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, রাজশাহীর বাঘা অঞ্চলে শীতের সময়ে তেমন একটা কাজ থাকে না। এজন্য গত অক্টোবরে চলে এসেছেন ফরিদপুরে। ফরিদপুর সদরের কানাইপুর ইউনিয়নের রণকাল গ্রামে একটি ফাঁকা মাঠের ভেতরের একটি ঘরে চেয়ারম্যান তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। রাতে তারা সেখানে ঘুমান এবং সকালে উঠে খেজুর গাছ থেকে খেজুর রস পেড়ে সেখানে রস জ্বালিয়ে গুড় বানিয়ে তা বিক্রি করেন। কখনও কাচা রসও হাড়ি ধরে বিক্রি করেন তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ টাকায়। বিক্রি না হলে সেই গুড় সংরক্ষণ করে রাখেন। সেগুলো তারা রাজশাহীতে নিয়ে যান। যেসব খেজুরগাছ তারা কাটেন মালিকদের তারা তিনভাগের একভাগ রস দেন এবং বাকি দুইভাগ নিজেরা রাখেন সেই রস থেকেই জ্বালিয়ে তৈরি করেন এই সব গুড়। তাদের যেসব গুড় সংরক্ষিত থাকে সেগুলো রাজশাহীতে নিয়ে যান এবং সারা বছর ধরে বিক্রি করেন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত কেজি দরে।
বিজ্ঞাপন
গাছি আখলাচুর মোল্লা বলেন, আমরা প্রতিবছর শীত মৌসুমে ফরিদপুর অঞ্চলে খেজুর গাছ কাটতে আসি। এখানে এসে গাছের মালিকদের সঙ্গে আমরা চুক্তি করি। যে রস আহরণ করা সম্ভব হয় তার তিন ভাগের এক ভাগ আমরা গাছের মালিককে দিয়ে দেই। বাকি দুই ভাগ রস আমরা তাফালে (রস জ্বাল দেওয়ার বড় পাত্র) জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করি।
আখলাচুর বলেন, এ বছর আমরা দুইজনে মোট ৭৫টি গাছ কাটছি। প্রতিদিন দুপুরের পর থেকে গাছে হাড়ি পাতা শুরু করি এবং পরদিন ভোররাত থেকে রস নামানো শুরু করে সকাল ৯টার ভেতরে রস নামিয়ে ফেলি। পরে গাছ মালিকের সঙ্গে রস ভাগ করে, আমাদের ভাগ এনে তাফালে জ্বালিয়ে গুড় বানাই।
তিনি বলেন, শহরের মানুষেরা আমাদের খোঁজ জানেন। তারা আসল গুড়ের খোঁজে আমাদের কাছ থেকেই গুড় কিনে নিয়ে যান ৪০০ টাকা দর কেজি করে। আমরা এখানে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা আয় করি।
তিনি আরও জানান, নয়ন মোল্লা (১২) ও জসিম মোল্লা (১৭) নামে দুই ছেলের বাবা আখলাচুর। বড় ছেলে জসীম মোল্লা বাড়ির কাজ করেন। ছোট ছেলে নয়ন মোল্লা স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে এ আয়ে ভালই চলে যায় তার সংসার।
আরেক গাছি রায়হান শেখ (২৩) বলেন, বাড়িতে বাবা-মা আছেন। আমি এখনও বিয়ে করিনি। সারাবছর বাবাকে সাহায্য সহযোগিতা করে থাকি। এবার প্রতিবেশী আখলাচুরের সাথে ফরিদপুরে খেজুরগাছ কাটতে এসেছি। আমরা এসে দেখেছি এই ফরিদপুরে অনেক খেজুরগাছ। বিশেষ করে কানাইপুরের প্রায় প্রতিটি সড়কের পাশ ধরেই শত শত খেজুরগাছ রয়েছে। এসব গাছ আমরা মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করে কেটে থাকি। এতে আমাদের যেমন লাভ হয়, তেমনি মালিকপক্ষও রস পেয়ে খুশি থাকে।
কানাইপুরের রনকাইল গ্রামের বাসিন্দা তোয়াব ফকির (৫৬)। তার বাড়ির আঙিনায় নয়টি খেজুরগাছ রয়েছে। তিনি বলেন, গ্রামে আগে অনেক গাছি ছিল। এখন গাছি নেই বললেই চলে। এজন্য আমাদের এখানে রাজশাহী অঞ্চল থেকে অনেক গাছিরা এসে এখানে থেকে গাছ কেটে রস আহরণ করে খেজুর গুড় বানিয়ে বিক্রি করে। এই ঐতিহ্য আমাদের এখানে অনেকদিনের। যারা আসে তাদের ব্যবহারও অমায়িক। তারা গাছ কেটে আমাদের রস দেয়। আমরাও খাটি রস পাই।
তিনি বলেন, আমার ৯টা গাছ থেকে প্রতিদিন প্রায় দুই থেকে আড়াই লিটার রস পেয়ে থাকি। কাচা রস পানের পাশাপাশি এসব রস দিয়ে আমরা গুড় বানিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের দিয়ে থাকি। নিজেরা বিভিন্ন পদের পিঠা খাই।
কানাইপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফকির মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, রনকাইলে একটি ফাঁকা জায়গায় কাচারি ঘরের মত রয়েছে। সেখানে ওই দুই ব্যক্তির অনুরোধে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া আমাদের ইউনিয়নের অন্যান্য গ্রামে যেসব গাছি একাজে আসেন তারা বিভিন্ন বাড়িতে পাঁচ-ছয় মাসের জন্য দুই থেকে তিন হাজার টাকায় ভাড়া থাকেন। সেখানে তারা নিজেদের ব্যবস্থায় রান্না করে থাকেন। মোট কথা এই ছয় মাস তারা আমাদের লোক হয়ে যান।
জহির হোসেন/আরকে