গ্রাহকের কোটি টাকা নিয়ে এনজিও ব্যবস্থাপকের টালবাহানা
ভুক্তভোগী গ্রাহক
কয়েক বছর ধরে বয়স্ক ভাতার টাকা পান ৬৪ বছর বয়সী ফুকমন বেগম। ছেলেদের সঙ্গে থাকায় বয়স্ক ভাতার অল্প কিছু টাকা জমে যায় তার হাতে। এভাবে কয়েক বছরের জমানো টাকা ভবিষ্যতের সংকট বা বিপদে-আপদের জন্য রাখেন রাজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি নামের একটি এনজিওতে।
একই গ্রামের বাসিন্দা মানিরুল ইসলাম। অন্যের জমিতে কাজ করেন। এর পাশাপাশি নিজেই অন্যের জমি ইজারা নিয়ে ধান চাষাবাদ করেন। দুই বছর আগে আমন ধান ওঠার পর বাড়িতে ছিল ১১০ মন ধান। এই ধান নিয়ে চলে যান রাজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির কর্মী মোজাহিদুল ইসলাম ওরফে সাহারুলের কাছে। চাল বিক্রির টাকা এনজিওতো জমা থাকবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন সাহারুল। সেই টাকা দিয়ে বাড়ি করার ইচ্ছা ছিল মানিরুলের। কিন্তু পরে ফেরত পাননি নিজের কষ্টার্জিত অর্থ।
বিজ্ঞাপন
চাঁপাইনবাবগঞ্জে কসবা ইউনিয়নের মেলডাঙ্গা গ্রামের তাহের আলীর ছেলে মোজাহিদুল ইসলাম ওরফে সাহারুল এভাবেই ভুয়া এনজিওর পাশ বই ও ব্যাংকের মতো চেক বই ছাপিয়ে ফুকমন, মানিরুলের মতো কয়েকশ গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি টাকা। কারো বাড়ি থেকে ধান নিয়ে গিয়ে, কারো গোয়াল ঘর থেকে গরু বা ছাগল খুলে নিয়ে নিজেই বিক্রি করে নিজের কাছেই টাকা জমা রেখেছেন। গ্রাহকদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, টাকা চাওয়া মাত্র পাওয়া যাবে। অথচ গত একবছর ধরে কয়েকশ গ্রাহকের টাকা ফেরত চেয়ে নিরাশ হয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, কারো বাড়িতে গরু ছাগল বিক্রি করা হয়েছে শুনলেই এনজিও-তে টাকা জমা নিতে বারবার বাড়িতে ধন্না দিতেন সাহারুল। তারপর উচ্চ মুনাফা দেওয়ার প্রলোভনে টাকা নিয়ে নিতেন। এমনকি কেউ জমির ধান বা গরু-ছাগল বিক্রি করবে জানতে পারলেও তার বাড়ি থেকে বিক্রি পণ্য নিয়ে গ্রাহককে ভুয়া পাশ বই ও চেক বই দিতেন। এভাবে কয়েকটি গ্রামের কয়েকশ গ্রাহকের এক কোটি ১২ লাখ টাকা আদায় করেছেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয় বাসিন্দা, ভুক্তভোগী গ্রাহক, জনপ্রতিনিধি সূত্রে জানা যায়, রাজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির সোনাইচন্ডী শাখার মাঠকর্মী হিসেবে সাহারুল গ্রাহকের থেকে টাকা আদায় করলেও তা এনজিওতে জমা না দিয়ে নিজের কাছেই রেখেছেন। জনগণের এই টাকা দিয়ে ধানের আড়ৎ, গরুর খামার, আম-পেয়ারার বাগান ও জমি কিনেছেন তিনি।
গত ১ বছর থেকে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিচ্ছেন না তিনি। উল্টো গ্রাহকেদরকেই নানারকম ভয়ভীতি ও হুমকি দিচ্ছেন। এ নিয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গদের নিয়ে সালিশ হয়। সালিশে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে সময় বেঁধে দিতে বলা হলেও তার সময় পেরিয়ে গেলেও জনগণের টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান সাহারুল। কসবা ইউনিয়নেট মহেশপুর, খান্দুরা, বালক্যাপাড়া, সোনাইচন্ডী, সব্দুলপুর গ্রামের জনসাধারণের কাছ থেকে এসব টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে।
মানিরুলের স্ত্রী বিজলী বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুই বছর আগে বাড়ি করার জন্য রাখা ১১১ মণ ধান নিয়ে যান সাহারুল। আরও কিছু নগদ টাকা দিয়ে মোট দুই লাখ টাকা জমা দেখানো হয়। পরে ১ বছর থেকে বাড়ি করার জন্য টাকা উঠাতে চাইলে, দেব-দিচ্ছি বলে টালবাহানা শুরু করে। সাহারুল এখন বলছে দিতে পারব না।
মেলাডাঙ্গা গ্রামের মৃত শাহজাহান আলীর ছেলে মো. আলাউদ্দিন (৭৪) জানান, ছেলে রাজমিস্ত্রীর কাজ করে। গরু বিক্রি, ছেলে ও মেয়ের জন্য জমানো ২ লাখ ৬৫ হাজার টাকা এনজিওতে রাখি। টাকা চাইলেও পাওয়া যাচ্ছে না। এখন মেয়ের সংসারে ঝামেলা শুরু হয়েছে। টাকা না পেলে মেয়ের সংসারটাই হয়ত থাকবে না। জামাই বলছে, টাকা না নিলে আসলে বাপের বাড়ি চলে যা।
একই গ্রামের মৃত আরশাদ আলী মন্ডলের ছেলে মো. রবু বলেন, গরু বিক্রি করা ৬২ হাজার টাকা রাজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটিতে জমা দিয়েছিলাম। নেওয়ার সময় সাহারুল বলেছিলো, যখন টাকা চাইবে, তখনি পেয়ে যাবে। গত এক বছর ধরে তার বাড়িতে বারবার ঘুরেও টাকা দিতে চাইছে না।
কাওসার আলী নামের এক যুবক ঢাকা পোস্টকে বলেন, মায়ের মাটি বিক্রি করা ৩ লাখ টাকা ছিল। ২ বছর আগে সাহারুল টাকা ইচ্ছেমতো সময়ে ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে সঞ্চয় নেয়। ১ বছর থেকে ফেরত দিচ্ছে না। এখন জানতে পারছি, জনগণের এসব টাকা সাহারুল এনজিওতে জমা দেয়নি। জনগণের টাকা নিয়ে জমি কিনেছে, খামার ও বাগান করেছে।
মেলাডাঙ্গা গ্রামের রাজমিস্ত্রী জুয়েল আলীর স্ত্রী সালমা খাতুন জানান, স্বামীর জমানো ও ধান বিক্রি করা ১ লাখ টাকা রেখেছিলাম। অনেক কষ্টে জমানো টাকা এখন ফেরত দিতে চাইছে না। চেয়ারম্যানের কাছে গেলেও কোনো সুরাহা পায়নি।
রাজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির সোনাইচন্ডী শাখার ব্যবস্থাপক মোজাহিদুল ইসলাম ওরফে সাহারুল জনগণের টাকা আত্নসাতের বিষয়টি অস্বীকার করেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, প্রথমে এনজিওতে আমি মাঠকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করি। সেসময় জনগণের ধান-গরু বিক্রি করে প্রায় ৮০ লাখ টাকা জমা নিয়েছি। পরে এই শাখায় আমি ব্যবস্থাপক হয়। পরে করোনাকালীন সময়ের এনজিও ক্ষতিগ্রস্ত হলে জনগণের টাকা দিতে সমস্যা তৈরি হয়। ধীরে ধীরে ঋণের টাকা তুলে টাকা পরিশোধ করছি। আর খামার বাগান এগুলো জনগণের নয় বরং আমার নিজের টাকায় করেছি।
সালিশের সাব কমিটির অন্যতম সদস্য ও সাবেক ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম জানান, জনগণের টাকা নিয়ে উল্টো তাদেরকেই হুমকি ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়রা খুবই ভোগান্তি ও হয়রানির মধ্যে রয়েছে।
কসবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাকারিয়া আল মেহরাব বলেন, স্থানীয়দের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সমাধানের লক্ষ্যে সালিশে বসা হয়। পরে মোজাহিদুল ইসলাম ওরফে সাহারুলকে টাকা পরিশোধ করতে নির্ধারিত সময় বেঁধে দেওয়া হলেও তা পরিশোধ করেনি।
নাচোল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাইমেনা সারমিন মুঠোফোনে ঢাকা পোস্টকে জানান, বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ-খবর নিয়ে এবিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জাহাঙ্গীর আলম/আরকে