নীলফামারী শহর থেকে দূরে নটখানা নামে এক নির্জন জায়গায় ১৯৬৫ সালে ৫২ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয় কুষ্ঠ হাসপাতাল। প্রায় ৫৭ বছর আগে গড়ে ওঠা এই হাসপাতালে এখনো মিলছে চিকিৎসা সেবা। এখানে মাত্র পাঁচ টাকায় দেওয়া হয় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা। শুধু নীলফামারী জেলা কিংবা রংপুর বিভাগের রোগীরাই নন। দেশের বিভিন্ন জায়গার কুষ্ঠ রোগীরা এখানে এসে চিকিৎসা নেন। চিকিৎসার পাশাপাশি এখান থেকে ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করা হয়।

নীলফামারী কুষ্ঠ হাসপাতালে পাঁচ টাকার টিকিট কেটে ভর্তি হতে হয়। এরপর রোগীদের থেকে আর কোনো টাকা নেওয়া হয় না। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের দেওয়া হয় ভালো মানের খাবার। সার্বক্ষণিক চিকিৎসক ও নার্সদের তত্ত্বাবধানে বিনামূল্যে দেওয়া হয় ওষুধ ও ব্যবস্থাপত্র। সুস্থ হয়ে ফিরে গিয়ে ফলোআপের জন্য আসলে আবারও কাটতে হবে পাঁচ টাকার টিকিট।

কুষ্ঠ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বছরে দেশে প্রায় ৪ হাজার কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত হয়। নীলফামারীসহ রাজধানীর মহাখালী ও সিলেটে রয়েছে এ রোগের চিকিৎসার বিশেষায়িত হাসপাতাল। এসব হাসপাতালে কুষ্ঠ আক্রান্তদের চিকিৎসা ও সেবা সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ১৯৮৫ সালে ৩৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ কুষ্ঠ রোগী এসব হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসত। বর্তমানে এই হার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে ৮ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ২০ শয্যা বিশিষ্ট এ হাসপাতালে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগীরা আসে চিকিৎসা নিতে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের খাবার পাশাপাশি সার্বক্ষণিক চিকিৎসক-নার্সদের তত্ত্বাবধানে বিনামূল্যে দেওয়া ওষুধ ও ব্যবস্থাপত্র।

কুষ্ঠ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন সত্তরোর্ধ্ব ডিমলা উপজেলা সদরের বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন মানুষ এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের ঘৃনার চোখে দেখে না। কিন্তু এক সময় মানুষজন কুষ্ঠ আক্রান্ত রোগীদের দেখলে কাছে আসতো না। নলকূপের পানি পান করতে দিতো না। গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হতো। এখন তেমন করে না কেউ। আমি প্রায় এক মাস ধরে এই হাসাপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছি। ওষুধপত্রসহ খাবার সব ঠিকঠাক মতো পাচ্ছি।

হাসপাতালের কর্মকর্তা ডা. শাহিনা আকতার ঢাকা পোস্টকে বলেন, কুসংস্কারই কুষ্ঠ রোগীদের চিকিৎসা ও প্রতিরোধে মূল প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। সময়মতো ও সঠিক চিকিৎসা নিলে এটি পুরোপুরি দূর হতে পারে। এই নিরাময়যোগ্য রোগ সম্পর্কে প্রচলিত কুসংস্কারগুলোর একটি হচ্ছে ‘পাপিষ্ঠ ব্যক্তি বা তাদের বংশধরগণ’ এ রোগে আক্রান্ত হয়। আসলে 'মাইক্রো ব্যাকটেরিয়াম লেপ্রি' নামে একটি জীবাণু এই রোগের জন্য দায়ী। এই হাসপাতালে আমরা ৫ টাকার বিনিময়ে চিকিৎসা দিয়ে থাকি।  

নীলফামারী সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৩০ সালের আগেই দেশ থেকে কুষ্ঠ রোগ নির্মূল করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। লক্ষ্য অর্জনে নীলফামারীতে মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন আমাদের কর্মীরা। কোনো ব্যক্তির দেহে কুষ্ঠ রোগ শনাক্ত হলে সকলকে সহানুভূতির সঙ্গে আচরণ করতে হবে এবং তিনি যাতে সুস্থ হয়ে ওঠেন, সেজন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এটি খুবই জরুরি। পরিবারে একজন আক্রান্ত হলে পরিবারের অন্যদেরও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে।

স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মতে, বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে এ রোগের বিস্তার রয়েছে। ঘনবসতিপূর্ণ ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এ রোগ ছড়ায়। আমাদের দেশে রংপুর, দিনাজপুর, সিলেট, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বগুড়া ও ঢাকা জেলায় এর প্রাদুর্ভাব রয়েছে। প্রায় ১২০ উপজেলায় এর বিস্তার আছে। মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। এ রোগে আক্রান্তদের স্থানভেদে জটিলতার পার্থক্য হতে পারে। হাত-পা বিকলাঙ্গ হতে পারে। ত্বক শুষ্ক ও রুক্ষ হয়ে যায়। ত্বকের অনুভূতি কমে যায়। 

শরিফুল ইসলাম/আরকে