আনোয়ারা বেগম

‘তখন ৭১ সাল। এলাকার ছেলিপেলি বুললো মিলিটারী এসেছে, মেয়ে মানুষদের বেইজ্জতি করবে। তখন আমাদের ভালোর জন্যি পল্লিতে (দুর্গাপুরে) রেখে আসলো। তার একমাস পরে গিয়ে বুললো ‘যদি আমি মরে যাই, তুমি দেশে থেকো।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জলিল শাহের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম। 

তিনি থাকেন রাজশাহী নগরীর তালাইমারী বাদুরতলার পদ্মা নদীর বাধের ওপরে একটি ঝুপড়িতে। সন্তানাদি না থাকায় নিজের বাড়ি বেদখল হওয়া তার ঠাঁই হয়েছে ঝুপড়িতে। এখন মানুষের বাড়িতে চেয়ে খেয়ে দিন যায় এই নারীর।

৭৭ বছর বয়সী এই নারী আক্ষেপ করে বলেন, ‘ডিসেম্বর আসলে খালি (শুধু) সাংবাদিকরা আসে। তারা এই বৃদ্ধার মুখে কথা শুনে। পেপার-পত্রিকায় আসে। কোনো লাভ হয় না। তারপরে আর তাদের দেহি না।’

তিনি বলেন, ‘এর কিছুদিন পরে হামার তালাইমারীর দোতালা বাড়ি দখল করে নেয় মিলিটারিরা। মেশিংগানে আমার বাড়ি বুঝাই করি থুছিল। সবকে ধরি  আনতো, আর চরের বালুর উপুরে গুলি করে মারতো। ঘটনার দিনে উরা চারজন ছিল। তাদের গুলি করে। আমার স্বামী ও বাক্কার গুলিত মারা যায়। আর ওই দুজনে হাতে, পায়ে গুলি লাগে। মুচা (গর্ত) খুড়ি ছিল, সেখিনে মাটিচাপা দেয়।’

স্থানীয়রা জানায়, নগরীর তলাইমারী শহিদ মিনারের পাশে শহীদদের নাম ফলক রয়েছে। সেখানে লেখা রয়েছে ‘সাবেক ১ নম্বর ওয়ার্ডের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নামের তালিকা লেখা আছে’। এই নাম ফলকে ৬৪ জন শহীদদের নাম রয়েছে। তারমধ্যে শহীদ ‘জলিল শাহ’ এই নাম আছে ছয় নম্বরে। জলিল শাহ যুদ্ধে নিহত হওয়ার বিষয়টি সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আব্দুল মান্নানসহ স্থানীয়রা নিশ্চিত করেছেন। 

তাদের দাবি- শহীদ জলিল শাহর স্ত্রীর অন্তত সরকারিভাবে একটা ব্যবস্থা হোক। দেশ স্বাধীনের পরে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া কৃতজ্ঞতা পত্র আর দুই হাজার টাকা পেয়েছিলেন তিনি। তবে সেই কৃতজ্ঞতা পত্রটি হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। তারপরে এত বছরেও মেলেনি কোনো সহায়তা।

স্থানীয়রা জানান, খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয়েছিল আনোয়ারা বেগমের। সে সময় সব কিছু ভালোই ছিল। স্বামী শহীদ জলিল শাহ ব্যবসা করতেন। নগরীর তালাইমারি বাদুরতলা এলাকাতেই ছিল তাদের দোতালা বাড়ি। কিন্তু বাড়িটি এখনও টিকে থাকলেও তাতে বসবাস করে অন্যেরা। স্বামী হারিয়ে নিরুপায় আনোয়ারা জীবিকার তাগিদে এক সময় বাড়ি বাড়ি গিয়ে হোমিও ওষুধ বিক্রি করতেন। সেই সময় এলাকায় ডাক্তর নানি হিসেবে পরিচিতি পান আনোয়ারা। পরে তাও বন্ধ হয়ে যায়। এখন শরীরে নানান রোগ বাসা বেঁধেছে। বেঁচে থাকার তাগিদে প্রতিবেশীদের কাছে হাত পেতেই জীবন কাটছে তার। তবে একবার কিছু টিন পেয়েছিলো। তা দিয়ে ঘর ঠিক করেছে। এখন শুধু বয়স্ক ভাতা পান।

সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আব্দুল মান্নান বলেন, এখনি সময় আনোয়ারার জন্য কিছু করার। অবহেলিতদের পাশে এসে দাঁড়াতে সরকার এবং বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানাই।

আরকে