রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) নির্বাচনে অংশ নেওয়া অনেক প্রার্থীই আচরণবিধি লঙ্ঘন করে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। পোস্টার সাঁটানো থেকে শুরু করে মাইকিং, গণসংযোগ, পথসভা, ক্যাম্প ও অফিস স্থাপনে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া আচরণবিধি মানতে প্রার্থীদের মধ্যে অনীহা দেখা গেছে। অনেক প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকরা নিজেদের ইচ্ছেমতো প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

তিন দিন ধরে প্রার্থীদের আচরণবিধি প্রতিপালনে মাঠে নেমেছেন নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। এদিকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করার আহ্বান সচেতন নাগরিকদের। এখনই আচরণবিধি প্রতিপালনে তৎপরতা বাড়ানো না গেলে ভোটের দিন বিধি ভঙ্গের প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।

গত ৯ ডিসেম্বর প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ হয়। এরপর শুরু হয় ভোট চাওয়ার আনুষ্ঠানিক প্রচারণা। ওইদিন থেকেই মেয়র, সাধারণ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের পক্ষে তাদের কর্মী-সমর্থকরা মোটরসাইকেল শোডাউনের মধ্য দিয়ে আচরণবিধি ভাঙতে শুরু করেন, যা এখনো বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রচারণার ক্ষেত্রে দেখা গেছে। শুধু মোটরসাইকেল শোডাউনই নয় গণসংযোগ, পথসভা, পোস্টার সাঁটানো ও মাইকিং করাসহ অন্যান্য কার্যক্রমেও মানা হচ্ছে আচরণবিধি। এ নিয়ে প্রার্থীরা একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ করছেন।

সরেজমিনে রংপুর মহানগরীর ১, ৩, ৪, ৬, ২০, ২১, ২২, ২৬, ২৭, ৩০, ৩২ ও ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী লতিফুর রহমান মিলন (হাতি) ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমিরুজ্জামান পিয়ালের (হাতপাখা) পক্ষে টানানো পোস্টারগুলো প্লাস্টিকের আবরণ দিয়ে মোড়ানো। শুধু মেয়র প্রার্থীই নয় কাউন্সিলর প্রার্থীদের অনেকের বিরুদ্ধেও বিধি ভঙ্গের একই অভিযোগ। দড়ি দিয়ে পোস্টার টানানোর পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় দেয়ালে, গাড়িতে ও বাড়িতে পোস্টার সাঁটাতে দেখা গেছে। কোথাও কোথাও কাউন্সিলর প্রার্থীরা একাধিক নির্বাচনী অফিস/ক্যাম্প স্থাপনের পাশাপাশি ভোটারদের নজর কাড়তে প্রতীক ঘিরে আলোকসজ্জা করেছেন। যদিও প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনের আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়টি অস্বীকার করে উল্টো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে করছেন পাল্টা অভিযোগ।

নগরীর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার সোহেল রানা বলেন, আমরা চাই ভোট শান্তিপূর্ণ হোক। যাতে আমরা কেন্দ্রে যেতে পারি। কেউ যেন কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে না পারে। কিন্তু আমার ওয়ার্ডে অনেকেই আচরণবিধির তোয়াক্কা করছেন না। কাউন্সিলর প্রার্থী আবু হাসান চঞ্চল ভোটকে ঘিরে অনিবন্ধিত একাধিক ক্লাব স্থাপন করেছেন। সেখানে তার এবং সমর্থনকারীদের ছবি সম্বলিত বিলবোর্ডটি আলোকসজ্জা করেছেন। ক্লাব ঘরগুলোতে গভীর রাত পর্যন্ত অনৈতিক কার্যকলাপও চলছে। এতে সাধারণ ভোটারদের মনে ভীতি সৃষ্টি হয়েছে।

একই ওয়ার্ডের কাউন্সিল প্রার্থী শফিকুল ইসলাম বলেন, নির্বাচন কমিশন আচরণবিধি প্রতিপালনে আমাদেরকে বারবার সতর্ক করে আসছে। কিন্তু আমাদের মধ্যে দু-একজন প্রভাবশালী প্রার্থী কোনো বিধি মানছেন না। টিফিন বাটি প্রতীকের কাউন্সিলর প্রার্থী আবু হাসান চঞ্চল আলোকসজ্জা করেছেন। বড় বড় টিফিন বাটি প্রতীক তৈরি করে পাড়া-মহল্লায় শোডাউন দিচ্ছেন। মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে সাধারণ ভোটারদের বিভ্রান্ত করার পাশাপাশি নিজের ভোটব্যাংক বাড়ানোর ষড়যন্ত্রও করছেন।

পোস্টার টানানোর বিধি লঙ্ঘন করে প্লাস্টিকের আবরণ ব্যবহারের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে উল্টো অন্যের বিরুদ্ধে পোস্টার অপসারণের অভিযোগ তুলেছেন আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার লতিফুর রহমান মিলন। হাতি প্রতীক নিয়ে ভোটযুদ্ধে থাকা এই প্রার্থীর দাবি, রাতের অন্ধকারে কে বা কারা তার সাঁটানো পোস্টার অপসারণ করছে। একইসঙ্গে তার কর্মীদেরকে বিভিন্নভাবে  
হয়রানির চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়ার অভিযোগ জাতীয় পার্টির প্রার্থীর দিকে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমাদের দল বিশাল। আমাদের নেতাকর্মী অনেক, তবুও আমরা কোনো স্লোগান দেইনি। গণসমাবেশ করিনি। আমরা গণসংযোগ করছি, পথসভা করছি। তারা লাঙ্গলের বিরাট প্রতীক নিয়ে রেখেছে। নির্বাচনী ফায়দা লুটে নেওয়ার জন্য মিথ্যা তথ্যসহ প্রতারণামূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। আমাদের যে ৬টি থানা আছে সেই ৬টি থানায় আমরা অফিস করেছি। এর বাইরে কোনো অফিস আমরা করিনি। এর বাইরে যে অফিস এটা নির্বাচনী নির্দেশনার বাইরে। কিন্তু জাতীয় পার্টি বিভিন্নস্থানে অফিস করেছে, আলোকসজ্জা করে রেখেছে।

এদিকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনের যে কথা বলা হচ্ছে তা মিথ্যা। তারা জনগণের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে বুঝতে পারছে লাঙ্গলের পক্ষেই  ফলাফল যাবে। এখন তারা আমার অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে মিথ্যা অভিযোগ করছে।

সদ্য সাবেক এই মেয়র বলেন, আমার ব্যাপারে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে এগুলো আমি অভিযোগ মনে করি না। আমাদের কাছে তো নির্বাচনী আইন ও বিধিপত্র আছে, সেগুলো মেনেই আমরা নির্বাচন পরিচালনা করছি। কোথাও গণসংযোগ করতে গেলে স্থানীয় লোকজন ভিড় করছে। আমার পেছনে পেছনে অনেকে ছুটে আসছেন। মানুষজন মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরে ঘুরে আমাকে উৎসাহ দিচ্ছেন। এজন্য আমি দায়ী না, ভোটারদেরকে আমি বাধা দিতে পারি না।

মোস্তাফিজার রহমান আরও বলেন, পথসভাগুলোতে লোক বেশি হওয়ায় জনসভা করার যে অভিযোগ উঠেছে তা নিছক মিথ্যা। অন্য প্রার্থীর জনসভায় তো লোকই হয় না। আমার জনসভায় লোক আসলে আমি কী করবো? মানুষের আবেগ-উচ্ছ্বাস ও এরশাদের প্রতি ভালোবাসা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এবার লাঙ্গল প্রতীকে ভোট বিপ্লব হবে। আশা করছি গত নির্বাচনের তুলনায় এবার আরও বেশি ভোটের ব্যবধানে জিতব ইনশাআল্লাহ।

রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম সচিব আবদুল বাতেন বলেন, প্রার্থীরা আচরণবিধি মেনে প্রচার-প্রচারণা করছে কি না সেটি তদারকি করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে ঘুরে দেখছেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকার একাধিক নির্বাচনী অফিস/ক্যাম্প বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পোস্টার সাঁটানো, মাইকিং, পথসভা, গণসংযোগসহ অন্যান্য বিষয়গুলোতে সব প্রার্থীকে সতর্ক করা হচ্ছে। আচরণবিধি প্রতিপালনে প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকদের পাশাপাশি সাধারণ ভোটারদেরও বোঝানো হচ্ছে। যদি কেউ ইচ্ছে করেই আচরণবিধি ভঙ্গ করে তাহলে নির্বাচনী আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, আগামী ২৭ ডিসেম্বর রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ওইদিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবেন ভোটাররা। এবার মেয়র পদে নয়জনসহ মোট ২৬০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এটি রংপুর সিটি করপোরেশনের তৃতীয় নির্বাচন। এর আগে ২০১৭ সালের ২১ ডিসেম্বর এ সিটিতে সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল। ওই নির্বাচনে একটি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ করা হলেও এবার পুরো সিটির ২২৯টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করবে নির্বাচন কমিশন।

এমজেইউ