উত্তরবঙ্গের শস্যভান্ডার খ্যাত সিরাজগঞ্জের চলনবিলে বর্ষার পানি কমে যাওয়ায় বিল ও ফসলের জমি থেকে অবাধে জাল দিয়ে শামুক সংগ্রহ করছেন কৃষক ও জেলেরা। পরে শামুক ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন হাঁসের খামার ও মাছের পুকুরে বিক্রি করছেন। এতে শামুক নিধনের ফলে বিলের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস ও ফসলহানির শঙ্কা করছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার তাড়াশ উপজেলার চলনবিল অঞ্চল থেকে বর্ষার পানি এখনো পুরোপুরি নেমে যায়নি। এ কারণে বিল অঞ্চলের মানুষজন বিভিন্ন অংশে বাড়তি আয়ের জন্য জাল দিয়ে অবাধে নিধন করছে ছোট-বড় শামুক। পরে শামুকগুলো উপজেলার মাগুরা বিনোদ ইউনিয়নের দীঘি সগুনা বাজার, হামকুড়িয়া বাজার, মান্নাননগর চৌরাস্তায় পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে।

বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা শামুক ব্যবসায়ীরা বস্তাভর্তি শামুক কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন অঞ্চলের হাঁসের খামার ও মাছের খাদ্য হিসেবে। শিকারিরা প্রতি বস্তা শামুক পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে ১১৫-১২০ টাকায় বিক্রি করেন। আর পাইকারি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন হাঁস ও মাছের খামারিদের কাছে প্রতি বস্তা ১৩০-১৪০ টাকায় বিক্রি করছেন। এভাবে প্রতিদিন শামুক নিধনের ফলে পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার পাশাপাশি হুমকিতে পড়ছে বিল অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য।

স্থানীয় আলতাব শেখ, জুলমাত হোসেন ও সাগর শেখ জানান, বিলপাড়ের খেটে খাওয়া মানুষ বাড়তি উপার্জনের আশায় প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছোট-বড় নৌকা নিয়ে বিলের বিভিন্ন অংশে বিশেষ করে ডুবে থাকা ফসলি জমি থেকে মই জাল, হেসি জাল ও হাত জাল দিয়ে শামুক সংগ্রহ করছেন। সংগ্রহ করা শামুক নৌকায় ভরে উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করছে। সেখান থেকে শামুক ব্যবসায়ীরা বস্তাভর্তি শামুক কিনে বিভিন্ন হাঁসের খামার, মাছের পুকুরে বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন বিলের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০টি নৌকায় করে শামুক আসে উপজেলার বিভিন্ন সড়কে। এগুলো বস্তায় ভরে প্রতি বস্তা ১১৫ টাকা থেকে ১২০ টাকা দরে ব্যাপারীদের কাছে বিক্রি করছেন জেলেরা। এলাকা যেন শামুকের হাটে পরিণত হয়েছে।

সৈয়দপুর গ্রামের শামুক শিকারি আব্দুর রহমান বলেন, বর্ষায় বিল অঞ্চলে মানুষের কাজকর্ম থাকে না। তাই মই জাল ও হেসি জাল দিয়ে আমরা শামুক সংগ্রহ করি। পানি কম থাকায় শামুক ধরে ব্যাপারীদের কাছে প্রতি বস্তা ১১৫ টাকা থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করি।

শামুক ব্যবসায়ী রিন্টু হোসেন ও আসলাম আলী বলেন, বর্ষা মৌসুমে চলনবিল ও ফসলের জমিতে ছোট-বড় ও মাঝারি সাইজের প্রচুর শামুক পাওয়া যায়। বিল ও ফসলের জমি থেকে পুরোপুরি পানি কমেনি। এ কারণে বিলপাড়ের মানুষজন বিভিন্ন আকারের শামুক সংগ্রহ করেন। এসব শামুক আমরা কিনে হাঁস ও মাছের খামারিদের কাছে বিক্রি করি। উপজেলার বিভিন্ন বাজারে প্রতিদিন প্রায় ৩শ বস্তা শামুক বিক্রি হয়। এখান থেকে গাড়িতে করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের খামারিরা নিয়ে যান।

উপজেলার হামকুড়িয়া গ্রামের হাঁসের খামারি আব্দুল জলিল বলেন, প্রতিবছর বিল এলাকা থেকে হাঁসের খাবারের জন্য শামুক কিনে আনা হয়। শামুক হাঁসের জন্য খুবই পুষ্টিকর খাদ্য।

চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব মিজানুর রহমান বলেন, বিলের প্রতিটি জলজ উদ্ভিদ ও প্রতিটি প্রাণী একে অন্যের পরিপূরক। একটি প্রাণী বা উদ্ভিদের ঘাটতি হলে অপর একাধিক উদ্ভিদ বা প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হবে এটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে এ বিলে শামুক বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে। কিছু টাকার জন্য মানুষ প্রকৃতির ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এতে চলনবিল আরও বিপর্যস্ত হতে পারে। এ কারণে প্রকৃতির সৃষ্ট চলনবিলকে রক্ষা করতে হবে। চলনবিলের খাল, বিল, জল রক্ষা করতে হবে। সেই সঙ্গে চলনবিলের প্রতিটি প্রাণী ও উদ্ভিদকে রক্ষা করতে হবে।

তাড়াশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লুৎফুলন্নাহার লুনা জানান, পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে বেশিরভাগ শামুক মারা যায়। মৃত শামুক মাটিতে মিশে কৃষি জমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। কিন্তু শামুক নিধন প্রতিরোধে কৃষি বিভাগের তেমন কোনো দিকনির্দেশনা নেই। তারপরও পরিবেশের যেন কোনো ক্ষতি না হয় বিষয়টি দেখা হবে।

তাড়াশ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশগুল আজাদ বলেন, শামুক পানিকে ফিল্টার করে। এগুলো বড় মাছেরও খাদ্য। জলের মধ্যে শামুকের যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি অতিরিক্ত হলে সেগুলো নিধন করাও যেতে পারে। তবে চলনবিলে কি পরিমাণ শামুক রয়েছে তা জরিপ করে সেভাবেই আহরণ করা দরকার।

সিরাজগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল গফুর বলেন, শামুক নিধন প্রতিরোধে আমাদের তেমন কোনো দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আমরা কাজ করে যাব। এমনিতেই শামুক নিধন বেশি মাত্রায় হওয়ায় হুমকিতে পড়েছে বিল অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য। যার প্রভাব পড়বে পরিবেশের ওপর। আমরা মানুষকে সচেতন করতে লিফলেট বিতরণ, উঠান বৈঠক, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও মাইকিং করে শামুক নিধন বন্ধে কাজ করে যাব। এছাড়া শামুক নিধন বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ হাতে নেওয়া হয়েছে। 

শুভ কুমার ঘোষ/এমজেইউ