১৭ বছর ধরে অন্যের জমিতে বসবাস করছেন হাসিনা
বাকপ্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে হাসিনা বেগম
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার ৫৩ বছর বয়সী বিধবা হাসিনা বেগম। সমাজের আর দশজন নারী যেখানে স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসারে সুখে জীবন যাপন করছেন, সেখানে হাসিনার জীবনের গল্পটা ভিন্ন। তার জীবন কাটছে ভাঙা ঘরে। ১৭ বছর ধরে মানুষের জমিতে ঘর বেঁধে দিন অতিবাহিত করছেন তিনি। স্বামী ও সন্তানহারা এবং এক প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে মানবেতর জীবন কাটছে তার। যেখানে গরিব হয়েও একসময় সুখে থেকে দুই বেলা নুন-ভাত জুটত, সেখানে আজ তার দিন কাটছে খেয়ে না-খেয়ে।
বৃষ্টির দিনে টিনের ছিদ্র দিয়ে টিপটিপ করে বৃষ্টির ফোঁটা ও বেড়া দিয়ে ঘরে বাতাস প্রবেশ করে। পাঁচ বছর ধরে এখন তিনি যেখানে আছেন, সেটা অন্যের জমি। এর আগে তিনি ১২ বছর বসবাস করেছিলেন আরেকজনের জমিতে ৷
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে তেঁতুলিয়া উপজেলার দেবনগড় ইউনিয়নের লতিফগছ এলাকায় দেখা যায়, হাসিনা বেগম তার ১২ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী ছেলে আবু কালামকে নিয়ে একটি জরাজীর্ণ ঘরে বসবাস করছেন। তিনি যে ঘরে বসবাস করেন, তার বেড়া ভাঙাচোরা। তা ছাড়া হাসিনা জানান,
জানা যায়, হাসিনা বেগম একই ইউনিয়নের নিজবাড়ি এলাকায় আবদুল আজিজ নামের এক পাথর ব্যবসায়ীর জমিতে ১২ বছর বসবাস করেন। আর হাসিনা বেগমের স্বামী এবং তিন ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে তার একটি সুখের পরিবার ছিল। মাঠেঘাটে কাজ করতেন তারা। তবে পাঁচ বছর আগে তার স্বামী ইদ্রিস আলী মারা গেলে তার পরিবারটি হয় অভিভাবকহীন। পরে তার বড় ছেলেকে বিয়ে দিলে তিনি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পৃথক সংসার গড়ে তোলেন। এরপর মেজ ছেলে আবু হাসানসহ তার দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে পাথরভাঙা মেশিনে কাজ করে জীপন যাপন করতেন হাসিনা বেগম। পরে তার মেজ ছেলে আবু হাসান তার সংসারের হাল ধরেন।
বিজ্ঞাপন
এদিকে কিছুদিন যেতে না যেতে হাসিনা বেগম যে ব্যবসায়ীর জমিতে ১২ বছর ধরে বসবাস করতেন, সেখান থেকে জমির মালিক তাকে উচ্ছেদ করে দেন। পরে তিনি সিরাজুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির জমিতে অস্থায়ীভাবে ঘর তুলে জীবন যাপন শুরু করেন। এখানে বাস করছেন পাঁচ বছর ধরে। এখানে সুখের মুখ দেখতে না দেখতে তার সংসারের হাল ধরা সেই মেজ ছেলে হঠাৎ করে ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। এতে উপার্জনক্ষম একমাত্র ছেলের মাথায় সমস্যা দেখা দেয়। আর এভাবে তার ছেলের পেছনে জমি কেনার জন্য যে টাকা জমিয়েছিলেন, তা ছেলের চিকিৎসায় শেষ করেন এবং অবশেষে ছয় মাস আগে তার ছেলে মারা যান।
অন্যদিকে বড় মেয়েকে কোনো রকমভাবে বিয়ে দিতে পারলেও, অভাবের তাড়নায় ছোট মেয়েকে ঢাকায় এক পরিচিত মানুষের বাড়িতে কাজ করাতে পাঠিয়েছেন। আর ১২ বছর বয়সী তার ছেলে আবু কালাম বাকপ্রতিবন্ধী। তাকে না পারছেন চিকিৎসা করাতে, না পারছেন দুটো ডাল-ভাত খাওয়াতে। তাই বুকভরা কষ্ট নিয়ে বর্তমানে তার প্রতিবন্ধী শিশুকে নিয়ে বসবাস করেন সেই ভাঙা ঘরে। তবে তার পাশেই তার বড় ছেলে মোস্তফা একইভাবে বসবাস করে আসছেন।
হাসিনা বেগম আগে পাথর ভাঙা মেশিনে শ্রমিক হিসেবে কাজ করলেও তিনি বর্তমানে অসুস্থ হওয়ায় আগের মতো কাজ করতে পারেন না। তাই তিনি জীবনযাপনের জন্য মানুষের বাড়ি থেকে বাঁশ কিনে এনে ঢাকি তৈরি করে বিক্রি করেন।
ঢাকা পোস্টকে হাসিনা বেগম বলেন, আমি দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে মানুষের জমিতে ভাঙা ঘরে বসবাস করি। আমার স্বামী নেই। তা ছাড়া যে ছেলেটা আমাকে উপার্জন করে খাওয়াত, সে ছয় মাস আগে মারা গেছে। ছোট মেয়েকে লেখাপড়া করাতে না পেরে মানুষের বাড়িতে কাজের জন্য দিয়েছি এবং ছোট ছেলে ভালো করে কথা বলতে পারে না। তাকে চিকিৎসা করাতে পারছি না। আমি গরিব মানুষ। চেয়ারম্যান ও মেম্বারের কাছে কতবার গিয়েছি, তারা আমাকে বিধবা ভাতা বা আমার ছেলের প্রতিবন্ধী ভাতাও করে দেননি। তারা আমাকে শুধু আশ্বাস দেন।
তিনি আরও বলেন, সরকার বলে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের ঘর করে দিচ্ছে। আমি কি ঘর পাওয়ার যোগ্য না? আমার ঘরও নাই, জমিও নাই। খুব কষ্ট করে জীপন যাপন করি। এতে সরকার যদি একটু সহযোগিতা করত, তাহলে অনেক উপকৃত হতাম আমি।
তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহাগ চন্দ্র সাহা বিধবা হাসিনা বেগমের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা হাসিনা বেগমের কথা জানতে পেলাম। তিনি একজন বিধবা ও বয়স্ক মানুষ। পাশাপাশি তার এক ছেলে প্রতিবন্ধী। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী দেশে গৃহহীন ও সহায়সম্বলহীন মানুষের জন্য মুজিব বর্ষে আশ্রয়ণ প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছে এবং এটি চলমান রয়েছে, সে ক্ষেত্রে আমরা তাকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর প্রদান করব। এ ছাড়া অন্যান্য যে সুবিধা রয়েছে, তাকে তার আওতায় নিয়ে আসা হবে।
এনএ