একজনের খাবার দুই-তিনজন ভাগ করে খেয়েছি
নিজের পারলারে কাজ করছেন আরিফুল ইসলাম আরিফ
‘এই জীবনে দুঃখ-কষ্ট তো লেগেই আছে। মানুষ এই পেটের জন্য কত কিছু করে। আমরা হাত না বাড়ালে (ভিক্ষাবৃত্তি) কেউ এসে সাহায্য করে না। করোনাভাইরাসের সময় একেকটা দিন যেন একেকটা বছর গেছে। এক বেলা খাবারের জন্য কারও কাছে ভিক্ষা চাইতে পারিনি। তখন সরকারের ত্রাণ আমাদের ভরসা ছিল। তাদের দেওয়া চাল-ডালের জন্য অপেক্ষায় ঘরে পড়ে থাকতাম। আমাদের তো বেশি চাওয়া-পাওয়া নেই। শুধু খেয়েপরে বেঁচে থাকাই আমাদের জীবনের একমাত্র ব্রত। আমরা চাই না এমন মহামারি ফিরে আসুক।’ এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য রাশি।
সমাজের আর দশজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মতো রাশিও দীর্ঘদিন ধরে ভিক্ষাবৃত্তি বা টাকা আদায়ের মতো পেশায় নিজেকে জড়িয়েছেন। সংঘবদ্ধভাবে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে রংপুরের মিঠাপুকুরে শঠিবাড়ি এলাকায় থাকেন রাশি। সেখানে তৃতীয় লিঙ্গের বেশ কয়েকজনের কথায় ফুটে ওঠে করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবকালে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা ও বৈষম্যের চিত্র।
বিজ্ঞাপন
করোনাকালে দীর্ঘ সাধারণ ছুটি, লকডাউন ও কাজ না থাকায় বিবর্ণ জীবন কেটেছে এই হিজড়া জনগোষ্ঠীর। পরিবার-সমাজ আর সামাজিক বৈষম্যের শিকারে পরিণত এই সম্প্রদায় করোনার ভয়াবহতার সময়ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে। তাদের কাছে পৌঁছেনি পর্যাপ্ত ত্রাণ। শুধু জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী আর কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দেওয়া খাদ্যসহায়তায় কেটেছে লকডাউনের একেকটি দিন।
তৃতীয় লিঙ্গের এসব সদস্যের সঙ্গে কথা ঢাকা পোস্টের। রুমা খাতুন বলেন, আমাদের তো কেউ মানুষই মনে করে না। সরকার একটু মুখ তুলে দেখছে। কিন্তু পরিবার-সমাজ তো এখনো আমাদের মেনে নেয়নি। আমরা এখনো সামাজিক নানা বৈষম্যের শিকার। করোনায় যখন সবকিছু বন্ধ, ঘর থেকে বের হতে পারিনি, তখন সবচেয়ে বেশি অসহায় বোধ করেছি। তখনকার মতো কষ্ট আগে কখনো হয়নি।
বিজ্ঞাপন
একই কথা রংপুর নগরের বসবাসরত তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠীর দলনেতা আনোয়ারুল ইসলাম রানারও। তিনি ন্যায় অধিকার তৃতীয় লিঙ্গ উন্নয়ন সংস্থার প্রধান। রানা বলেন, আমরা হিজড়ারা সরকারিভাবে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি পেলেও আর্থসামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্তি পাইনি। করোনার সময়ে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি, পেটের ক্ষুধা কী রকম যন্ত্রণার। আমরা সরকারের দেওয়া ২ হাজার ৫০০ টাকাও পাইনি। জেলা প্রশাসন আর সেনাবাহিনী থেকে কিছু চাল, ডাল, তেল, আলু পেয়েছিলাম। সঙ্গে ১ হাজার ২০০ টাকাও দিয়েছিল। এ ছাড়া কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আমাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল। কিন্তু মেয়র-কাউন্সিলর কেউ সহায়তা করেননি। আমরা নাকি তাদের ভোটার না। এ জন্য ত্রাণও দেয়নি।
আশ্রুসিক্ত নয়নে তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য রানা বলেন, জেলায় ৩৭০ জনের বেশি সদস্য রয়েছে। এই জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষ খাদ্যসহায়তা পেয়েছে। সেটা ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি হবে না। তখন আমরা একজনের খাবার দুই-তিনজন মিলে ভাগ করে খেয়েছি। অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করেছি। এখন করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় ভালো আছি। শুধু আমরা নই, পৃথিবীর কেউই চায় না এ রকম মহামারি ফিরে আসুক।
এদিকে সাধারণ তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা দোকান থেকে এবং নতুন জন্ম নেওয়া শিশুদের নিয়ে নাচগান করে টাকা জোগাড় করে থাকলেও পীরগঞ্জের তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য নিপুণ তা করেন না। ২০১৫ সালে সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে পারলার ও রান্নাবিষয়ক প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর নিজের জীবনকে বদলে ফেলেছেন তিনি। আরিফুল ইসলাম আরিফ থেকে নাম বদলে নিপুণ হলেও নিজেকে সমাজের চোখে দৃষ্টান্ত হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন তিনি। গড়ে তুলেছেন জেন্টস বিউটি পারলার এবং চায়নিজ ফুড কর্নার। সেখানে কয়েকজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করেছেন। কিন্তু করোনাকালে তার সেই ব্যবসায় ধস নামে। সেই পরিস্থিতি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি নিপুণ। তারপরও পথে নামেননি। বরং ধারদেনা করে নিজের ব্যবসাকে ধরে রেখেছেন। সঙ্গে সমাজের অবহেলিত মানুষের জন্য নিজের উপার্জনকে উজাড় করে দিয়েছেন।
রংপুর নগরের তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য পাপড়ি বলেন, করোনাকালে অনাহারে-অর্ধাহারে আমাদের জীবন চলছে। আমাদের তো ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া ব্যক্তিক উন্নয়ন নেই, সমৃদ্ধিও নেই। শুধু খেয়ে-বেঁচে থাকাই জীবনের একমাত্র ব্রত। অন্য কোনো জনগোষ্ঠী পারিবারিক ও সামাজিকভাবে এত বেশি চরম অবজ্ঞা ও বৈষম্যের শিকার হয়নি। অথচ আমরা জন্মের পর থেকে অপমান, উপহাস, তাচ্ছিল্য আর নিগ্রহের শিকার।
করোনাকালে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের পাশে সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উই ফর দেম। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা জীবন ঘোষ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা মানুষের জন্য কাজ করি। আমাদের চোখে সবাই মানুষ। কিন্তু সমাজের চোখে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ভিন্নভাবে দেখা হয়। করোনাকালে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ আদায়ের পথ বন্ধ ছিল। এ সময়টায় তাদের পাশে আমাদের সংগঠন থেকে চাল-ডাল-তেল-আলুসহ অন্যান্য খাদ্যসহায়তা দিয়েছি। তখন তাদের শোচনীয় অবস্থা দেখে আমাদেরও খারাপ লেগেছিল।
আরেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাংলার চোখের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান তানবীর হোসেন আশরাফী ঢাকা পোস্টকে বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের চরম নিম্নাবস্থা চলছে। তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো অর্জন নেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান, বিশুদ্ধ পানি, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, সঞ্চয়, মাথাপিছু আয়সহ প্রভৃতি সূচকে তাদের অবস্থা শোচনীয়। অবস্থানগত কারণে সমাজ তাদের প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা প্রদর্শন করছে। এই প্রান্তিকতার মাঝে তারা করোনাকালে অনেক বেশি কষ্টে দিনাতিপাত করেছে। আমরা সেখানে চেষ্টা করেছি সামর্থ্য অনুযায়ী খাদ্যসহায়তা পৌঁছে দেওয়ার। হয়তো তৃতীয় লিঙ্গের সবার হাতে হাতে ত্রাণসামগ্রী দিতে পারিনি, তবে আমাদের চেষ্টার কমতি ছিল না।
রংপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক আবদুল মতিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনাকালে সরকার তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের পাশে ছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন থেকে আমরা তাদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করেছিলাম। এই সহায়তার পাশাপাশি হিজড়া জনগোষ্ঠী যেন আর পিছিয়ে না পড়ে, এ জন্য বর্তমান সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
তিনি আরও বলেন, ২০১৩ সাল থেকে সমাজসেবা অধিদফতরের আওতায় বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে রংপুর জেলার তালিকাভুক্ত তৃতীয় লিঙ্গের ৩৭০ জনের মধ্য থেকে বিভিন্ন ট্রেডে ১৫০ জনকে ৫০ দিন এবং ৩০ জনকে ১২ দিন মেয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জন বিভিন্ন কর্মসংস্থানে যুক্ত হয়েছেন। তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় এনে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
রংপুর জেলা প্রশাসক আসিব আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনাকালে হিজড়াদেরসহ সমাজের নিম্নবৃত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা চরম হুমকির মুখে পড়েছিল। সরকার তাদের খাদ্য নিরাপত্তাসহ সব বিষয়ে সজাগ ছিল। আমরা জেলার প্রতিটি উপজেলায় ইউএনও, চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে কর্মহীন, অসহায় ও দুস্থ মানুষদের মাঝে খাদ্যসহায়তা ও ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছি। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষও সেই সুবিধা পেয়েছেন। শুধু করোনাকালে নয়, হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসতে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
এনএ