কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ভবন। দীর্ঘদিন ধরেই এক পাশে খালি পড়ে থাকা পুরোনো ভবনটি ক্রমেই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। খেলার মাঠের একপাশে শিশুদের খেলাধুলার আনুসাঙ্গিক যন্ত্রপাতি ও মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে রয়েছে টাইলস বাঁধানো দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার।

সবুজ বৃক্ষরাজিতে চারপাশ ঘেরা এই বিদ্যালয়ে নেই কোনো কোলাহল। শিক্ষার পরিবেশের জন্য এখানে সব কিছুই বিদ্যমান থাকলেও যাদের জন্য এ আয়োজন সেই প্রয়োজনীয় শিক্ষার্থীই নেই। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় এখন প্রতিনিয়ত কমছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের বেলতৈল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র এটি। 

স্থানীয়দের দাবি- এখনই যদি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী টানার কোনো ব্যবস্থা করা না হয়, তাহলে এক সময় শিক্ষার্থী শূন্য হয়ে যাবে বিদ্যালয়টি। 

 

 

স্থানীয় বাসিন্দা ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য মতে, গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের নিভৃত গ্রাম বেলতৈল। এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষই নিরক্ষর ও কৃষিনির্ভর ছিল এক সময়। গ্রামের সাধারণ মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে ১৯৮০ সালে স্থানীয়দের উদ্যোগে টিনের ছাপড়া ঘরে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৩ সালে বর্তমান সরকার বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ করে। বিদ্যালয়টি জাতীয়করণের সময় হলে দ্রুত চারজন শিক্ষককে নিয়োগ দেয় পরিচালনা পর্ষদ। যাদের মধ্যে কয়েকজনের বাড়ি ছিল বিদ্যালয় থেকে দূরে। জাতীয়করণ হওয়ার পর তারা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের যোগসাজসে নিজেদের সুবিধামতো বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে যান। পরে এক সময় বিদ্যালয়টিতে ধীরে ধীরে শিক্ষক কমতে থাকে। তবে প্রধান শিক্ষকের বাড়ি বিদ্যালয়ের কাছে হওয়ায় তিনি বিদ্যালয়টিতে থেকে যান। 

এদিকে ১৯৯৮ সালে বিদ্যালয়ে একটি একতলা ভবন নির্মাণ করা হয়। সেটির পরিবেশ ভালো থাকার পরও ২০১৮-২০১৯ সালে পাঁচ কক্ষবিশিষ্ট একটি দোতলা ভবন ও ছয়টি শৌচাগারসহ দোতলা একটি ওয়াশ ব্লক নির্মাণ করা হয়। 

সরকারি সকল ধরনের সুবিধা থাকার পরও বিদ্যালয়ের হাজিরা খাতায় প্রাকপ্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ভর্তি রয়েছে মাত্র ৫২ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে অধিকাংশই অনুপস্থিত থাকে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষা অফিসের নজরদারির অভাব ও দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়টিতে একজন শিক্ষক দায়িত্ব পালন করায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যদিও সম্প্রতি নতুন আরও তিন  শিক্ষককে এই বিদ্যালয়ে পদায়ন করা হয়েছে। যাদের মধ্যে একজন যোগদান করেননি।   

সরেজমিনে বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়টি অনেকটা নীরব। নেই শিশুদের ছোটাছুটি, শ্রেণিকক্ষও নীরব। সরকারি এই বিদ্যালয়ে প্রতি শ্রেণিতে ৩০ জন করে শিক্ষার্থী থাকার কথা থাকলেও এখানে প্রাক প্রাথমিক শ্রেণিতে ১১ জন শিক্ষার্থীর স্থলে উপস্থিত ছিল পাঁচজন, প্রথম শ্রেণিতে ১১ জনের মধ্যে উপস্থিত ছিল আটজন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৯ জনের মধ্যে উপস্থিত ছিল চারজন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৯ জনের স্থলে উপস্থিতি ছিল আটজন, চতুর্থ শ্রেণিতে সাতজন ও পঞ্চম শ্রেণিতে পাঁচজন শিক্ষার্থীর স্থলে উপস্থিত ছিল তিনজন শিক্ষার্থী।

স্থানীয় অভিভাবক আতাউর রহমান বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় এ বিদ্যালয়ে শিক্ষক থাকে না। শিক্ষক ছাড়া লেখাপড়াও হয় না। বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া ও খেলাধুলা ছাড়া তেমন কোনো পরিবেশ নেই। তাই আমি আমার তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীকে পাশের শিরিশগুরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছি।

স্থানীয় মোসলেম উদ্দিন বলেন, সঠিক সময়ে বিদ্যালয়ে আসা ও শিক্ষকদের খেয়াল খুশিমতো ছুটি দেয়া নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় শিক্ষার্থী কমে গেছে। প্রয়োজন মোতাবেক শিক্ষক না দেওয়া অন্যতম কারণ। 

তিনি বলেন, অভিভাবকসহ এলাকার মানুষদের সম্পৃক্ত করতে হবে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে। বিদ্যালয় কমিটি, শিক্ষক ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতাই পারে বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশসহ শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনতে।
 
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু হানিফা বলেন, ২০২০ সালেও এ বিদ্যালয়ে ১০৪ জন শিক্ষার্থী ছিল। পরে করোনার ধাক্কাতে অনেকেই ঝরে যায়। এছাড়াও বড় একটি প্রতিবন্ধকতা ছিল। বিদ্যালয়ে শিক্ষক না দেওয়ায় দুই বছর এ বিদ্যালয়ে তাকে একাই দাপ্তরিক কাজ ও সকল শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতে হয়েছে। দেখা গেছে এমন দিন হয়েছে তাকে জরুরি কাজে উপজেলা সদরে যেতে হয়েছে। সেদিন তো আর ক্লাস হয়নি। আবার একজনের পক্ষে সব ক্লাস নেওয়াও সম্ভব হয়নি। এভাবে অভিভাবকদের মধ্যে একটি আস্থহীনতা তৈরি হয়ে তারা অনেকেই শিক্ষার্থী নিয়ে বিভিন্ন কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করিয়েছে। সম্প্রতি আবার শিক্ষক এসেছে। এবার আমরা আশাবাদী হয়ে উঠছি।

বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি শরিফ উদ্দিন বলেন, শুধু শিক্ষক না থাকায় এমন অবস্থা হয়েছে। দীর্ঘদিন একজন শিক্ষক দিয়ে এই বিদ্যালয় চলেছে। প্রত্যন্ত এলাকা হওয়ায় অনেকেই এই বিদ্যালয়ে আসতে চায় না। অভিভাবকরা নানা দুশ্চিন্তায় তাদের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গেছে। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার আবেদন করলেও কেউ কর্ণপাত করেননি। সবার আগে শিক্ষক দিতে হবে তাহলেই অভিভাবকদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে।

গাজীপুর জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোফাজ্জল হোসেন বলেন, কাঙ্খিত শিক্ষার্থী না থাকা খুবই হতাশার বিষয়। সম্প্রতি তিনজন শিক্ষক দিলেও একজন যোগদান করেননি। কেন শিক্ষার্থী কমছে সে বিষয়টি নিয়ে আমরা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। 

শিহাব খান/আরএআর