গ্রেপ্তার মানছুরা

বরগুনার দরিদ্র পরিবারের এক কিশোরীকে পাচার ও ধর্ষণের ঘটনায় মাঠকর্মী মানছুরাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মানছুরার কাজ ছিল গ্রামের দরিদ্র মেয়েদের টার্গেট করে বিভিন্ন প্রলোভনে বরিশালে এনে দেহ ব্যবসার আস্তানায় বিক্রি করে দেওয়া। বিনিময়ে ব্যবসার পার্সেন্টেজ পেতেন তিনি।

তালতলী থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী শাখাওয়াত হোসেন তপু বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, তালতলী থানায় হওয়া মারধরের একটি মামলায় মানছুরা আক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ তথ্য বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানায়ও জানানো হয়েছে। কোতোয়ালি থানায় হওয়া মানবপাচার, ধর্ষণ ও পর্নোগ্রাফি মামলায় এজারহারভুক্ত আসামি তিনি। কোতোয়ালি থানা পুলিশও এই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখাবে বলে জানিয়েছে।

এদিকে বরিশাল নগরীর ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাংলাদেশ ব্যাংক সংলগ্ন মহিলা কলেজ গলির ইঞ্জিনিয়ার হাবিবুর রহমানের মালিকানাধীন হাবিব ভবনের দ্বিতীয় তলার কালামের আস্তানা থেকে উদ্ধার হওয়া আরেক কিশোরী জানিয়েছে, পার্লারে চাকরি দেওয়ার কথা বলে বাকেরগঞ্জ থেকে বরিশালে এনে তাকেও কালামের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন মানছুরা। টানা দুই সপ্তাহ একটি ফ্ল্যাটে বিভিন্ন লোকের সঙ্গে শারীরিক সর্ম্পক স্থাপনে বাধ্য করা হতো। এতে রাজি না হলে বিভিন্ন স্টাইলে নির্যাতন চালাতেন কালাম ও তার সহযোগীরা।

উদ্ধার হওয়া দুই কিশোরীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বরগুনার তালতলী উপজেলার ১ নম্বর পঁচা কোড়ালিয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড হুলাটানা গ্রামের বাসিন্দা কালাম দীর্ঘদিন বরিশালে থেকে কিশোরীদের অপহরণ করে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করতেন। একই গ্রামের বকুল মুন্সীর মেয়ে মানছুরা আক্তারও বিক্রি হয়ে গিয়েছিল কালামের আস্তানায়। সেখান থেকে বেড়িয়ে নিজেই কালামের হয়ে কিশোরীদের ফাঁদে ফেলার কাজে নামেন। তারই ধারাবাহিকতায় কমপক্ষে ছয়জনকে এখন পর্যন্ত এই আস্তানায় বিক্রি করেন। 

যদিও এখন পর্যন্ত দুইজনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়েছে। ওই দুই কিশোরী বলে, মাঠকর্মী হিসেবে মানছুরা কাজ করতেন। এছাড়া আরও ৪/৫ জন রয়েছেন যারা পাচারে কাজ করেন। 

এই চক্রের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা এক কিশোরী বলে, আমাকে যখন রুপাতলী থেকে কালামের কাছে তুলে দেওয়া হয়, তখন যারা চোখ বাঁধেন তাদের আমি চিনি না। আবার মারধর করে ২২ ফেব্রুয়ারি যখন ভোররাতে আমাকে গাড়িতে তোলা হয় এবং গ্রামের বাড়িতে পৌছানো হয় তখন ৪/৫ জন লোক আমাকে নজরদারিতে রাখে এবং অপরিচিত সেই লোকেরা বাসে, বাসস্ট্যান্ডে বিভিন্ন ধরনের ভয় দেখায়। তাছাড়া কথায় কথায় কালাম আমার গলা চেপে ধরতো-বলতো কথা না শুনলে মার্ডার করে ফেলা হবে। মায়ের সঙ্গে একবার মোবাইলে কথা বলার সুযোগ দেয়, তবে তারা পাশে বসে যা শিখিয়ে দিতো সেটাই বলতে হতো। এছাড়া পাচার ও ধর্ষণের শিকার হয়ে বাড়ি ফিরে যখন মাকে পুরো ঘটনা বলি তখন মানছুরার বাবা বকুল মুন্সী আমাকে মারধর করে। এসব বিষয়ে তালতলী থানার ওসি এবং আমার ইউপি মেম্বার আলমগীর হোসেনের কাছে সব বলেছি। আমি ধর্ষণের শিকার হয়েছি, আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে, আমাকে মারধর করেছে- সব বলেছি। কিন্তু সে এসবের কিছু না শুনে মানছুরার বাবার সঙ্গে আমাদের মারামারির ঘটনা ঘটেছে বলে মামলা নিয়েছে। বরিশালে না এলে এই চক্র ধরা যেত না বলেও জানায় নির্যাতনের শিকার ওই কিশোরী।

নির্যাতনের শিকার ওই কিশোরীর মা বলেন, পাচারকারী চক্রটিকে ধরিয়ে দেওয়ার পর আমাকে ওয়ার্ড মেম্বার বিভিন্ন ধরনের ভয় দেখাচ্ছেন। থানার এক পুলিশ সদস্য মোবাইলে কল করে এসব সাংবাদিকদের কাছে না বলার জন্য বলেন। আমি আতঙ্কে আছি আর কোনো দিন বাড়ি ফিরতে পারবো কিনা। 

বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, পাচার ও ধর্ষণের শিকার হওয়ার কিশোরী চিকিৎসাধীন রয়েছে। এ ঘটনার মূলহোতা কালাম, তার স্ত্রী রাহিমা বেগম, ইব্রাহিম এবং মানছুরার সরাসরি সম্পৃক্ততা পেয়েছি। তাদের বিরুদ্ধে মানবপাচার, ধর্ষণ এবং পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা গ্রহণ করেছি।

কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুল্লাহ আল-বারী বলেন, পাচার চক্রের সঙ্গে যারা জড়িত রয়েছেন, তাদের সকলকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

প্রসঙ্গত, গতকাল মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) রাতে বরিশাল নগরীর একটি আস্তানা থেকে পাচার হওয়া দুই কিশোরীকে উদ্ধার করে পুলিশ। এছাড়া আরও পাঁচজনকে আটক করে। যার মধ্যে দুইজন পাচার চক্রের হোতা। বাকিরা ওই আস্তানায় ফূর্তি করতে আসতেন। কাজের প্রলোভন দেখিয়ে দরিদ্র কিশোরীদের চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হতো সেই আস্তানায়। সেখানে বাধ্য করা হতো দেহ ব্যবসায়।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর