মায়ের স্বপ্নপূরণে নারীদের জন্য গড়লেন মাদরাসা
রূপগঞ্জ উপজেলার মধুখালী গ্রামে একদল আল্লাহভক্ত নারী আল্লাহকে খুশি করতে মাঠে নেমেছেন। তারা ঘরে ঘরে নারীদের দ্বীনি শিক্ষার আলো দান করবেন। শুধু তা-ই নয়, নারী শিশু, স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছাত্রীদের মাঝেও কোরআনের আলো ছড়িয়ে দিতে কাজ করছেন তারা। তাদের লক্ষ্য, রূপগঞ্জসহ নারায়ণগঞ্জ জেলায় আল কোরআনের আলো ছড়িয়ে দেওয়া হবে পর্যায়ক্রমে। একপর্যায়ে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে সারা বাংলাদেশে।
এমন লক্ষ্য নিয়েই উপজেলার মধুখালী গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অর্থায়নে গড়ে তোলা হয়েছে ‘নূরজাহান বেগম হিফজুল কুরআন মহিলা মাদরাসা’ নামের একটি দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। এ কাজে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন মধুখালী গ্রামেরই বাসিন্দা নুরুল ইসলাম মোল্লার ছেলে কামরুল হাসান মোল্লা। তিনি জানান, তার মরহুম মায়ের স্মৃতি ধরে রাখাসহ মহান আল্লাহকে খুশি করতেই তিনি এই প্রতিষ্ঠান দাঁড় করেছেন।
বিজ্ঞাপন
এদিকে মাদরাসার পরিচালক ও অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন মুহতামিমা ফারহানা তাবাস্সুম। এখানে শিক্ষক হিসেবে রয়েছেন হাফেজা জান্নাতুল মাওয়া, আলেমা সুমাইয়া আক্তার, আলেমা খাদিজা বেগমসহ অভিজ্ঞ ও উচ্চশিক্ষিত নারীরা।
তাদের অভিমত, নারী ক্ষমতায়ন, নারী জাগরণের অগ্রযাত্রায় ঘরে কিংবা বাইরে কোথাও পিছিয়ে নেই নারী। শহর থেকে গ্রামে নারীদের শিক্ষার পরিবেশ ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু নারীদের দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তুলনামূলক কিছুটা কম। তবে মা শিক্ষিত হলে সন্তান শিক্ষিত হবে। তাদের এই অগ্রযাত্রাকে স্বাগত জানাচ্ছেন স্থানীয় জনগণ।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে দেখা যায়, নূরজাহান বেগম হিফজুল কুরআন মহিলা মাদরাসায় স্থানীয় কর্মজীবি নারী, গৃহবধূ ও শিশুদের মাঝে পবিত্র কোরআন, হাদিস ও ইসলামি রীতিনীতি শিক্ষা দিচ্ছেন শিক্ষকরা। পাঠদানরত শিক্ষার্থীদের মাঝে সারে চার বছরের শিশু শিক্ষার্থী হা মীম অনর্গল সহিহভাবে ২০টি হাদিস বাংলা অর্থসহ মুখস্থ শোনায়। সে নুরানি বিভাগে ৪০টি হাদিস মুখস্থ করবে। পাশাপাশি নাজেরা হিসেবে পবিত্র কোরআন পড়ার সক্ষমতাসহ নামাজ শিক্ষা অর্জন করতে পারবে। একইভাবে সাত বছরের শিক্ষার্থী সাদিয়ার পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতে মুগ্ধ হয় অভিভাবক ও শিক্ষকসহ এই প্রতিবেদক।
মাদরাসার শিক্ষকরা ঢাকা পোস্টকে জানান, গ্রামের মানুষদের মাঝে মেয়ে শিশু জন্ম নিলে সাধারণত এখনো অনেকটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। এ ক্ষেত্রে মেয়েদের ঘরে বন্দি রেখে পর্দার আড়ালে বড় করে শতভাগ সংসারী মেয়ে হিসেবে গড়ে তোলার মানসিকতা তৈরি হয় অনেক পরিবারে। আর পারিবারিক নির্দেশনায় নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বন্দি রেখেই মানুষ করা হয় মেয়েদের, যা নারী সমাজের বিকাশের অন্তরায়। এসব থেকে দূরে রাখতে নারীদের জন্য দ্বীনি শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিক কর্মে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে এ প্রতিষ্ঠানটি।
ইতোমধ্যে উপজেলার মধুখালী, ভক্তবাড়ি, হারিন্দা, সুরিয়াবো, গুতিয়াবো, পিতলগঞ্জের বাসিন্দাদের মাঝে ব্যাপক সাড়া পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এখানে দ্বীনি ভীত মজবুত করতে সন্তানদের ইসলামিক নিয়মে লালন-পালন করতে গৃহবধূ ও মায়েদের জন্য আলাদাভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ ছাড়া সব বয়সী নারীদের জন্য নুরানি পদ্ধতিতে সহিহ কোরআন শিক্ষা, নামাজের নিয়মকানুন, মাসআলা, সুরা-কেরাত, মাশক, কোরআন-হাদিসের আলোচনা ও দোয়া মাহফিলের মাধ্যমে দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণের বিশেষ সুব্যবস্থাও রেখেছে কর্তৃপক্ষ।
পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদানের জন্য আশপাশের ছয় গ্রামের নারী-শিশুদের মাঝে নুরানি, হেফজ, নাজেরা, প্লে বিভাগ থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে। মাদরাসা কারিকুলামে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেছেন।
মধুখালী এলাকার গৃহবধূ মিথিলা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে আমি ভালো করে কোরআন পড়তে জানতাম না। তাই সন্তানদের পড়াতে পারতাম না। এ মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার পর এখন নিজে শিখেছি, সন্তানদেরও পড়াতে পারছি। তাই প্রত্যেক মায়ের আগে সহিহ-শুদ্ধভাবে কোরআন শিক্ষা করা খুবই জরুরি। অন্যথায় মা ভুল পড়ালে সন্তানও ভুল শিখবে। এতে শিশুদের ভবিষ্যৎ শিক্ষায় বিরূপ প্রভাব পড়বে।
মুসলিম হিসেবে প্রত্যেক নারী-পুরুষকে দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করা অত্যন্ত জরুরি। আর যেকোনো পেশায় যুক্ত নারীদেরও দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এখনো অনেক পরিবার মেয়েসন্তান হলে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। অথচ নারীরা শিক্ষিত হয়ে সব কাজে সমানভাবে পর্দা রক্ষা করে অংশ নিতে পারেন। কিন্তু এখনো নারীদের পড়াশোনাসহ সব কাজে উপযুক্ত পরিবেশের অভাব রয়েছে। তাদের জন্য দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম।
ফারহানা তাবাস্সুম, মাদরাসার পরিচালক ও অধ্যক্ষ
তিনি আরও বলেন, মধুখালী এলাকায় সেই সুযোগ সৃষ্টিতে এ মাদরাসাটি দ্বীনি পাঠদানের কাজ করে যাচ্ছে। এতে ইতিমধ্যে ব্যাপক সাড়া পেয়েছি আমরা। আর যারা এখানে ভর্তি হচ্ছেন, তাদের শিক্ষা অর্জনপদ্ধতি, দক্ষতা দেখে অন্যরাও উৎসাহী হচ্ছে। ইতোমধ্যে শতাধিক নারী ও শিশু এ মাদরাসায় শিক্ষা গ্রহণ করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা তাহছিনা আক্তার নিশাত বলেন, নারীদের জন্য এ প্রতিষ্ঠানটি হতে পারে বিশেষ মডেল। কারণ এখানে শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে যে পোশাক-পরিচ্ছদ, নারীদের পর্দার ব্যবস্থাসহ সহিহ-শুদ্ধভাবে মনোমুগ্ধকর পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত আশপাশের মুসলমানদের দারুণভাবে উৎসাহী করে তুলছে।
এ বিষয়ে মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা কামরুল হাসান মোল্লা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার মা চাইতেন গ্রামের নারীরা যেন দ্বীনি শিক্ষা লাভ করেন। কিন্তু মায়ের জীবদ্দশায় নানা কারণে প্রতিষ্ঠান করতে পারিনি। এখন সে স্বপ্ন পূরণে আমাদের গ্রামের উচ্চ শিক্ষিত বোনেরা আমাকে এ প্রতিষ্ঠান গড়তে সহযোগিতা করেছেন। তারা সুন্দরভাবে কোরআনের শিক্ষা নারীদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে। আমার বাড়ির পাশেই একখণ্ড জমিতে এ মাদরাসায় শিশুরা যখন কোরআন তিলাওয়াত করে তখন আমার মন ভরে যায়। মনে হচ্ছে এটি আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ।
তিনি আরও বলেন, মহান আল্লাহকে খুশি করতে হলে আল কোরআনের আলো দ্রুত ছড়িয়ে দিতে প্রতিটি পরিবারের মাঝে আরও আধুনিকতা নিয়ে অবহেলিত নারীদের মাঝে দ্বীনি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। কারণ, সুশিক্ষায় শিক্ষিত নারীরাই পারেন সুন্দর শুশৃঙ্খল একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিতে। এ ক্ষেত্রে সমাজের সচেতন সুযোগ্য মানুষগুলো সজাগ হলে রূপগঞ্জ উপজেলাসহ সারা নারায়ণগঞ্জেই আল কোরআনের পাখি উড়ে বেড়াবে। আর উৎসাহিত হয়ে এ শিক্ষার ব্যাপক প্রসারে সারা বাংলাদেশেই দ্বীনি শিক্ষা ছড়িয়ে পড়বে বলে আমি আশাবাদী।
মো. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া/এনএ