গোমতি নদী

নদীর নাম গোমতি। চলনবিলের বুক চিরে এই নদীর প্রবাহ। বাঘাবাড়ি থেকে উত্তর জনপদের প্রায় আটটি জেলার সঙ্গে নৌ চলাচলের মাধ্যম এটি। একসময়ের উত্তাল গোমতি এখন দখল আর দূষণের কবলে। কেবল বর্ষা মৌসুমেই এখন নদীতে কিছু ছোট নৌকা চলাচল করে। আর শুষ্ক মৌসুমে নদীর বুকে জেগে ওঠে চর।

তবে নদীর পূর্বের অবস্থা ফিরিয়ে আনতে খনন কাজ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল নদীর প্রস্থ ও গভীরতা বৃদ্ধি এবং নাব্যতা ফেরানো। যাতে নৌ চলাচল স্বাভাবিক হয়। বিশেষ করে বিল এলাকার মানুষের জন্য নদীর পানিতে সেচ সুবিধা পৌঁছানো এবং উম্মুক্ত জলরাশিতে মাছ শিকার করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে এসবের কিছুই হয়নি। নদী খনন করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু নাব্যতা ফেরেনি। খনন করা মাটি ভেঙে আবার সংকুচিত হয়েছে নদী। শুধু যে গোমতি নদীর ক্ষেত্রেই এমনটি হয়েছে তা নয়। খনন কাজ চলছে চলনবিলের আত্রাই, গুমানী, তুলশীগঙ্গা নদীর। প্রতিটি নদী খননেই এমন অনিয়ম করা হয়েছে। নিয়ম মোতাবেক কোনো নদীই খনন করা হয়নি।

স্থানীয়রা বলছেন, খনন করা মাটি নদী তীর হতে ১ হাজার মিটার দূরে রাখার কথা। অথচ খননের মাটি নদীর দুই পাশে রাখা হয়েছে। সেই মাটি আবার নদীতেই ঢলে যাচ্ছে। মাটি ভরাট হয়ে আবার পলি পরেছে নদীর বুকে। তীর ঘেঁষে মাটির বাঁধ তৈরি হওয়ায় সংকুচিত হয়েছে নদী। নদী খননে এমন দৃশ্যমান অনিয়ম করা হলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি  বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। শুধু খননে অনিয়ম নয়, দখল ও দূষণ আর ভরাটের কবলে পরে অস্তিত্ব হারাচ্ছে চলনবিলের প্রায় ২২টি নদী। চলনবিলের খাল বিল ও নদী রক্ষার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন।

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, রাজশাহীর চারঘাট থেকে উৎপত্তি হয়ে চলনবিলের মধ্য দিয়ে মুশাখা, নন্দকুজা, চিকনাইসহ বাঘাবাড়ির হুড়াসাগর হয়ে যমুনায় মিলিত হয়েছে বড়াল। প্রমত্তা বড়ালের চারঘাট এলাকায় ৪শ থেকে ৬শ ফুট নদী দখল করে দুইটি স্থাপনা,এবং চাটমোহর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সংলগ্ন আরোও ৮শ ফুট নদী দখল করে মার্কেট নির্মাণ করেছে চাটমোহর পৌরসভা। এছাড়া পাবনার আটঘরিয়া থেকে বনপাড়া পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার নদী দখল করে সরকারি অফিসসহ ব্যক্তিমালিকানা বহু স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। আত্রাই, নন্দকুঁজা, গুমানী, গুড়, করতোয়া, তুলসি চেঁচিয়া, তুলশীগঙ্গা, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গাসহ প্রায় ২২টি নদীর দুইপাড় দখল করে বসতি নির্মাণ অব্যাহত আছে। ১৮টি খালের মধ্যে নবীরহাজীর জোলা, হকসাহেবের খাল, নিমাইচড়া খাল, বেশানীর খাল, গুমানী খাল, উলিপুর খাল, সাঙ্গুয়া খাল,দোবিলা খাল, কিশোরখালির খাল, বেহুলারখাড়ি, বাকইখাড়া, গোহালখাড়া, গাড়াবাড়ি খাল, কুমারভাঙ্গা খাল, জানিগাছার জোলা, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর অস্তিত্ব হারাতে চলছে।

জানা গেছে, চলনবিলের ৩টি নদী কমপক্ষে (৩০ মিটার) ৯৭ ফুট প্রস্থ এবং (২.৫ মিটার) ৮ফুট গভীর করে খনন করার কথা। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই করা হয়নি। আত্রাই নদীর ভাঙ্গুড়ার এরশাদ নগর থেকে গুরুদাসপুর রাবারড্যাম পর্যন্ত ৯৭ কিলোমিটার খনন কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আত্রাই নদীর খনন কাজের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়েষ্টার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং কে ৯২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় হয়েছে। অপরদিকে গুমানি নদীর খনন কাজ করেছেন জেলে থাকা ক্যাসিনো সাহেদ। ওয়েষ্টার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রকল্প ইনচার্জ ইয়াকুব আলী জানান, তারা উপরের নির্দেশনা মোতাবেক ২.২ থেকে ২.৪ মিটার পর্যন্ত গভীর করছেন। তবে সব স্থানে খনন করা হচ্ছে না। নদী খনন দেখভালের দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিএ’র সহকারী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান নদী খননের ব্যাপারে কোনো তথ্য দেননি। এ বিষয়ে কোনো বক্তব্যও দেননি তিনি।

এদিকে ইম্পেরিয়েল গেজেট অব ইন্ডিয়া বই থেকে জানা যায়, চলনবিল অঞ্চলে ১ হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, ৪ হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খাল রয়েছে। এরমধ্যে প্রধান নদী ৯টি, এবং ২০টি খাল রয়েছে। ২৩ হাজারের মত বড় বড় পানির জলাধার ছিল। যা বেশির ভাগই বেদখল হয়ে গেছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. রেদওয়ানুর রহমানের প্রবন্ধ থেকে পাওয়া তথ্যে জানাগেছে, প্রায় ৩০ বছর আগেও চলনবিলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত এসব নদীতে বছর জুড়েই ৬ থেকে ১২ ফুট পানি থাকত। বছরের পর বছর পলি জমে এসব নদী এখন ভরাট হয়ে গেছে। পরিসংখ্যান মতে, প্রতি বছর ২২২১/২  মিলিয়ন ঘনফুট পলি প্রবেশ করে, ৫৩ মিলিয়ন ঘনফুট পলি বর্ষায় চলনবিল থেকে সরে যায়।

চলনবিল রক্ষা কমিটির সভাপতি মানবাধিকার কর্মী অধ্যাপক আত্হার হোসেন বলেন, এসব নদী ও খালের প্রায় সবই বেদখল। তাছাড়া যেভাবে নদীগুলো খনন করা হচ্ছে তাতে প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছেনা।

পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ও বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব মিজানুর রহমান জানান, দেশের বৃহত্তম পদ্মা-যমুনা নদী এবং বিশাল জলাভূমি চলনবিলের মধ্যে প্রধান সংযোগ নদী বড়াল। এই নদী ৪টি জেলা ও ৮টি উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ৮০’র দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ড অপরিকল্পিতভাবে নদীর উৎস মুখ ও ৪৬ কিলোমিটার ভাটি এলাকার আটঘরিয়ায় স্লুইসগেট নির্মাণ, পাবনার চাটমোহরে তিনটি ক্রসবাঁধ ও স্লুইসগেট নির্মাণ করে নদীর প্রবাহ বাঁধাগ্রস্ত করেছে। সম্প্রতি  হাইকোর্ট থেকে বড়াল রক্ষার আদেশ দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারের চলনবিল মৎস্য প্রকল্প থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এক সমীক্ষায় দেখা যায় ১৯৮২ সালে মোট ১ লাখ ৭৭ হাজার ৬১ জন জেলে এসব নদী ও খাল এবং জলাশয়ে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো। পর্যায়ক্রমে তা কমে ২০০৬ সালে ৭৫ হাজারে দাঁড়িয়েছে। যা বর্তমান সময়ে আরো কম বলে জনাগেছে।

নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আবু রায়হান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নদী থেকে অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযান চলমান আছে। বড়াল, নারদ ও মুসাখা নদীর খনন কাজ অল্প দিনেই শুরু হবে।

এমআইএইচ