মাদকের অন্ধকার ভুলে যেতে চান লাকি
লাকি আক্তারের কাছে সেলাই মেশিন তুলে দেন জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার
অভাব ও সঙ্গ দোষে মাদকদ্রব্য ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন লাকি আক্তার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, এলাকায় শক্ত সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন তিনি। অভিযানে ৮১৫ পিস ইয়াবাসহ আটক হন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব-৮) হাতে। দীর্ঘদিন কারাগারে থেকে শিক্ষা হয়েছে— এই অন্ধকার পথে আর ফিরবেন না তিনি।
এবার কালো কোনো ব্যবসা নয়; পরিশ্রমের উপার্জনে ছেলে-মেয়ের মুখে খাবার তুলে দেবেন তিনি। তার এই মনোভাবকে সাধুবাদ জানিয়ে এগিয়ে এসেছে জেলা প্রশাসন ও সমাজসেবা অধিদফতর। উপার্জনের জন্য উপহার দিয়েছে সেলাই মেশিন। সেই সেলাই মেশিনকে জীবন বদলের হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন এক সময়ের ওই মাদকদ্রব্য ব্যবসায়ী লাকি।
বিজ্ঞাপন
বর্তমানে বরিশাল নগরীর দক্ষিণ আলেকান্দা আমতলা এলাকার বাসিন্দা আমান খানের স্ত্রী লাকি। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে নিয়ে পরিবার। স্বামী আমান খান নগরীতে থ্রি-হুইলার মাহিন্দ্র চালায়। দিনে রোজগার যা হতো তাতে ভালোই চলে।
কিন্তু স্থানীয় একটি চক্রের সঙ্গে পরিচয় হয় একদিন। সেখানে রাতারাতি বিপুল টাকার মালিক বনে যাওয়ার স্বপ্ন দেখানো হয়। কৌশলটা হচ্ছে কুমিল্লার বর্ডার থেকে মাদক এনে বরিশালে বিক্রি করা।
বিজ্ঞাপন
র্যাব জানায়, লাকি আক্তার কুমিল্লার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে মাদকের বড় চালান সংগ্রহ করে সড়ক পথে ঢাকার সদরঘাট হয়ে লঞ্চে বরিশালে নিয়ে আসত। মাদকদ্রব্য পরিবহনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ এড়ানোর জন্য সে তার দুই বছরের শিশু সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে যেত। প্রশাসনকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য কখনো রাইস কুকার, কখনো শীতলপাটি, কখনো ফলের কার্টন ব্যবহার করত।
মাদকদ্রব্য নিজের বাসায় না রেখে নগরীর ২০ নম্বর ওয়ার্ডের বৈদ্যপাড়া এলাকার শিবলু বিলাস নামের বাড়ির কেয়ারটেকার মিন্টু হাওলাদারের ঘর ও স্টোররুমে মজুদ করত। সেখান থেকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সংলগ্ন এলাকায় মাদকসেবীদের কাছে পৌঁছে দিত। বছরের পর বছর চলছিল এ ব্যবসা।
২০২০ সালের ১২ জুলাই র্যাবের অভিযানে প্রথমে আটক হন মিন্টু হাওলাদার। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আটক হন লাকি আক্তার। এ সময়ে তাদের কাছ থেকে ৪ কেজি গাঁজা ও ৮১৫ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা দায়ের করা হয়।
লাকি আক্তার জানান, গ্রেফতারের পর দুটি ছেলেমেয়ে রেখে কারাগারে থাকায় খুবই কষ্ট হচ্ছিল। সে এক অবর্ণনীয় জীবন। আমি মানতেই পারছিলাম না ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দুটি রেখে দূরে কোথাও থাকতে হচ্ছে। কিন্তু ৯ মাস আমি কারাগারে ছিলাম। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর কখনো এই পথে পা বাড়াব না।
তিনি আরও জানান, কারাগারে থাকাকালীন কারাগার পরিচালিত অপরাধ সংশোধন ও পুনর্বাসন সমিতি থেকে সেলাই মেশিন চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। চলতি বছরের ৮ মার্চ জামিনে মুক্তি পান লাকি আক্তার। এর একদিন পরে জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রবেশন অফিসার সাজ্জাদ পারভেজের কাছে সাহায্যের আবেদন করলে বিষয়টি আমলে নেয় সমাজসেবা অধিদফতর ও জেলা প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার (১৮ মার্চ) জেলা প্রশাসনের সভাকক্ষে লাকি আক্তারের কাছে সেলাই মেশিন তুলে দেন জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার। এ সময় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) প্রশান্ত কুমার দাস, এনডিসি নাজমুল হুদা, প্রবেশন অফিসার সাজ্জাদ পারভেজ প্রমুখ।
সেলাই মেশিন নেওয়ার সময় জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন লাকি, আর কখনো তিনি মাদক বিক্রিতে জড়াবেন না। প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, আমরা চেষ্টা করছি বিপথগামী, অসহায় মানুষদের সাহায্য করে আলোর পথে নিয়ে আসতে।
সেলাই মেশিন পেয়ে লাকি আকতার বলেন, স্বামী মাহিন্দ্র চালায়। আর আমি সেলাই মেশিন চালাব। এতেই সংসার ভালোভাবে চলবে। আর কখনো মাদক বিক্রির পথে যাব না। তিনি বলেন, আমি আমার অতীত ভুলে যেতে চাই।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/এমএসআর