অযত্ন–অবহেলায় পড়ে রয়েছে নওগাঁ স্টেডিয়াম। অথচ এক সময় এই স্টেডিয়াম থেকেই দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ছড়িয়ে পড়েছেন অনেক বড় বড় ফুটবলার ও ক্রিকেটার। যারা জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ঢাকার বিভিন্ন ক্রিকেট ও ফুটবল ক্লাবে এখনো খেলছেন অনেকেই। কিন্তু বর্তমানে নানা অব্যবস্থাপনা আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে স্টেডিয়ামটি। স্টেডিয়ামটির জৌলুস ফিরিয়ে এনে খেলার পরিবেশ সৃষ্টিতে সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন খেলোয়াড়রা।

জেলা ক্রীড়া সংস্থার তথ্যমতে, ১৯৫৯ সালের ১ জুন ৬ একরের বেশি জমির উপর প্রতিষ্ঠা করা হয় নওগাঁ জেলা স্টেডিয়াম। ১৯৮৪ সালে স্টেডিয়ামের আয়তন বৃদ্ধি করে মাঠের পশ্চিম দিকে ৩০০ ফুট ও দক্ষিণ দিকে ছাউনিসহ ২০০ ফুট দৈর্ঘ্যের গ্যালারি নির্মাণ করা হয়। এছাড়াও একটি প্যাভিলিয়ন গ্যালারি সংযোজন করায় স্টেডিয়ামটিতে সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার দর্শক একসঙ্গে বসে খেলা দেখতে পারত। ২০১৬ সালে স্টেডিয়ামের ভেতরের জলাবদ্ধতা নিরসনে এক কোটি ৬০ লাখ টাকায় পুকুর ভরাট করে মাঠ সম্প্রসারণ করা হয়। এরপর ক্রীড়া সংস্থার নতুন কমিটি গঠন না হওয়ায় নতুন করে কোনো সংস্কার করা হয়নি। দীর্ঘ সাড়ে ৬ বছর পর গত ২২ ফেব্রুয়ারি সাধারণ সম্পাদক পদসহ ২৭টি পদে একক প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন প্রার্থীরা।

সম্প্রতি সরেজমিনে নওগাঁ জেলা স্টেডিয়ামে গিয়ে দেখা যায়, জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে স্টেডিয়ামের দক্ষিণ দিকের ছাউনিসহ ২০০ ফুট দৈর্ঘ্যের গ্যালারি। ময়লা-আবর্জনা এবং আগাছায় ছেয়ে গেছে চারদিক। ৫ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতার স্টেডিয়ামের অন্য গ্যালারিগুলোর অবস্থাও একই। গ্যালারির বিম ও দেয়ালে দেখা দিয়েছে ফাটল। দেয়াল ও বিম ফেটে বের হয়ে এসেছে মরিচাযুক্ত রড। পলেস্তারা খসে পড়ে গেছে প্রায় সবখানেই। যেখানে জন্মেছে বিভিন্ন ধরনের আগাছা ও ঘাস। ভেঙে পড়েছে পশ্চিম দিকের গ্যালারির কিছু অংশ। ভেতরে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই মাঠে সৃষ্টি হচ্ছে কৃত্রিম জলাবদ্ধতা। স্টেডিয়ামের ভেতরে ক্রীড়া সংস্থার ভবনটিও হয়ে পড়েছে ঝুঁকিপূর্ণ। ভবনটির ভেতরে স্যাঁতস্যাতে দেয়ালের কারণে ছড়িয়েছে দুর্গন্ধ। মাঠের চারদিকের সীমানা প্রাচীরের বেশ কিছু অংশ ভেঙে পড়ায় সেখানে অবাধে যাতায়াত করছে মাদকসেবীরা।

এতো সংকটের মধ্যেও খেলোয়াড়রা বন্ধ করেনি তাদের অনুশীলন। জরাজীর্ণ মাঠে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনুশীলন করছেন খেলোয়াড়রা। দুই দশক আগে শহরের ১০টিরও বেশি ফুটবল একাডেমির কোচ এই মাঠে এসে অনুশীলন করাতো। তবে জেলা স্টেডিয়ামের বেহাল অবস্থা এবং শহরে খেলাধুলার জন্য প্রয়োজনীয় ফাঁকা স্থানে একের পর এক স্থাপনা নির্মাণ করায় অনেক একাডেমি এখন বন্ধ হয়ে গেছে। স্টেডিয়ামের সামনের ফাঁকা জায়গাটি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে দূরপাল্লার বাসস্ট্যান্ড হিসেবে। এ থেকে জেলা ক্রীড়া সংস্থার আয়-ব্যয়ের কোনো হিসাব নেই। বাসস্ট্যান্ডকে কেন্দ্র করে স্টেডিয়ামের প্রধান ফটকের পাশে নির্মাণ করা হয়েছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা। রহস্যজনক কারণে এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে প্রশাসনের দৃশ্যমান কোনো ভূমিকাও দেখা যায় না।

স্টেডিয়ামে অনুশীলনরত অবস্থায় কথা হয় তরুণ ক্রিকেটার ওমর ফারুকের সঙ্গে। তিনি বলেন, শৈশবের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে থাকা এই স্টেডিয়ামে এক সময় মাঠ-গ্যালারি সবকিছুই পরিচ্ছন্ন ছিলো। এখন সেই চিত্র বদলে গেছে। গ্যালারিগুলো ময়লার ভাগাড় এবং আগাছায় ছেয়ে গেছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার কারণে অনুশীলন বন্ধ করতে হয়। খেলায় মনোনিবেশ করতে যা প্রয়োজন তা এই মাঠে নেই। বাসা থেকে পরিপাটি হয়ে মাঠে এলেই মাদকসেবীরা র‌্যাগিং শুরু করে। চারদিকে ইয়াবা, ফেন্সিডিলসহ নানা মাদকের আসর বসে। এসব দেখলেই খেলার মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়।

শহরের হাট নওগাঁ মহল্লার তরুণ ফুটবলার রবিউল আওয়াল মাহি বলেন, জেলা স্টেডিয়ামে অনুশীলনের সময় অনেক অসুবিধার মুখে পড়তে হয়। ক্লান্ত হয়ে পড়লে পানি খাওয়ার মতো কোন ব্যবস্থা নেই। মাত্র একটি শৌচাগার রয়েছে, তাও তালাবদ্ধ রাখা হয়। তাই এখন স্টেডিয়ামের চেয়ে বাহিরের মাঠগুলোতে অনুশীলন বেশি করার চেষ্টা করি। স্টেডিয়ামটি দ্রুত সংস্কারের মাধ্যমে খেলার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি জানান তিনি।

জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার এনামুল হক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ক্রীড়া সংস্থার নেতৃত্বে যখন যেই কমিটি আসে তখন তারাই লুটেপুটে খেতে শুরু করে। আয়-ব্যয়ের হিসাবে এখন পর্যন্ত কোন কমিটিই তেমন স্বচ্ছতা আনতে পারেনি। এই স্টেডিয়ামকে ঘিরে আমাদের অন্যরকম আবেগ-অনুভূতি কাজ করে। ক্রীড়া সংস্থার আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা এলেই স্টেডিয়াম তার হারানো জৌলুস আবারো ফিরে পাবে।

জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মামুনুর রশিদ মামুন বলেন, দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে নওগাঁর খেলোয়াড়রা কোন অংশেই কম নয়। প্রতি বছর এখান থেকে অসংখ্য খেলোয়াড় বিকেএসপিতে সুযোগ পাচ্ছে। এনামুল হক ও মোসাদ্দেক হোসেন এক সময় জাতীয় দলে মাঠ দাপিয়ে খেলেছেন। এ জেলারই সন্তান রিমন এখনো জাতীয় দল ও বসুন্ধরা কিংসে খেলছেন। অথচ আমাদের স্টেডিয়ামের জরাজীর্ণ অবস্থার দিকে কারোর নজর নেই। যেকোনো মুহুর্তে মাঠে গ্যালারি ভেঙে পড়তে পারে। তাই আধুনিক স্টেডিয়াম নির্মাণে সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।

জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ইকবাল শাহরিয়ার রাসেল বলেন, এই স্টেডিয়ামে অনুশীলন করে নওগাঁ থেকে অনেক খেলোয়াড় তৈরি হয়েছে। তবে মাঠের বর্তমান জরাজীর্ণ পরিস্থিতির কারণে খেলার পরিবেশ নেই বললেই চলে। দীর্ঘ বছর ক্রীড়া সংস্থার কমিটি না থাকায় মাঠটি অযত্ন অবহেলায় এতোদিন পড়েছিল। স্টেডিয়ামের গ্যালারি যেকোনো মুহুর্তে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই খেলোয়াড়দের সুবিধার কথা মাথায় রেখে শীঘ্রই মাঠটির আংশিক সংস্কার করা হবে। স্টেডিয়ামের সামনের দখল হওয়া জায়গাটি শীঘ্রই পুনরুদ্ধার করা হবে বলেও জানান তিনি।

নওগাঁর জেলা প্রশাসক ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি খালিদ মেহেদী হাসান বলেন, জেলা স্টেডিয়ামে অনেক খেলোয়াড় নিয়মিত অনুশীলন করে থাকেন। তাদের উৎসাহিত করতে মাঝেমধ্যেই স্টেডিয়ামে বিভিন্ন টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। মাঠটি সংস্কার, ইনডোর ব্যবস্থা চালু করাসহ আরো উন্নত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো সুন্দর আধুনিক স্টেডিয়াম নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।

আরমান হোসেন রুমন/এবিএস