বিআরটিএতে বাধ্য হয়ে নিতে হয় দালালের সহযোগিতা
মাদারীপুরে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) অফিসে মোটরসাইকেলের জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে এসেছেন কালকিনি উপজেলার ফাসিয়াতলা গ্রামের বোরহান হোসেন। তিনি পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক। গত এক বছর ধরে তিনি মোটরসাইকেলের ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়নের জন্য বিআরটিএ অফিসে ঘুরছেন। তাকে বারবার পড়তে হচ্ছে ভোগান্তির মুখে।
বোরহান হোসেন ঢাকা পোস্টের কাছে অভিযোগ করে জানান, বিআরটিএ অফিসে সেবা পেতে তাকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে তাই এক রকম বাধ্য হয়েই তাকে নিতে হয়েছে দালালের সহযোগিতা।
বিজ্ঞাপন
তিনি জানান, দালালের শরণাপন্ন না হয়ে তিনি নিয়ম অনুযায়ী লাইসেন্স করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে দীর্ঘদিন অনেক সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে তবুও সমাধান পাননি। তাই দালালের সহযোগিতা নিয়েছেন তিনি।
জানা যায়, অধিকাংশ দিনই অনেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পরও বিকেল ৩টার আগেই ডিজিটাল প্লেট নম্বর দেওয়া বন্ধ করে দেয় বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। বোরহান অভিযোগ করে বলেন, অনেক সময় দালালরা লাইনে দাঁড়ানো মানুষের কাছ থেকে টাকা খেয়ে অনেকের সিরিয়াল এগিয়ে দেয় এবং ডিজিটাল লাইসেন্সসহ প্লেট নম্বর লাগিয়ে দেয়। এদিকে আমরা যারা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি তাদের বলা হয়- আজ অফিস শেষ, যারা লাইসেন্স এবং মোটরসাইকেলের নতুন প্লেট লাগাবেন সেই স্যারেরা চলে গেছেন।
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার (৬ এপ্রিল) সকালে মাদারীপুর বিআরটিএ অফিসের বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় ঢাকা পোস্টের কথা হয় বোরহান হোসেনসহ অনেকের সঙ্গে। এ সময় ভুক্তভোগী মেহেদী হাসান, নয়ন, মাসুদ, মহসিন, রায়হান, আজাহার, সুমন, সাব্বির, হৃদয়, মুন্না, সুমন বেপারী, খাইরুল, রনিসহ বেশ কয়েকজন একই অভিযোগ করে বলেন, সহিদুর ও বাবুল দালালসহ এরকম বেশ কয়েকজন আছেন। যাদের কাছে না গেলে কোনো কাজ হয় না।
অভিযোগ করে তারা বলেন, একদিকে আসতে হয় অনেক দূর থেকে, রাস্তায় থাকে যানজট আবার শুক্রবার বন্ধ। বিআরটিএ অফিসে পর্যাপ্ত লোকবল থাকার পরেও দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোগান্তির শিকার হতে হয় আমাদের।
আরও পড়ুনঃ বিআরটিএ থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিচ্ছেন না গ্রাহকরা!
বোরহান হোসেন আরও বলেন, পরপর বেশ কয়েকদিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও সময় মতো ডিজিটাল নম্বর প্লেট লাগাতে পারিনি। একদিকে থাকে পেটের চিন্তা অন্যদিকে ডিজিটাল নম্বর লাগাতে হবে, না হলে ট্র্যাফিক পুলিশ বিভিন্নভাবে হয়রানি করে এবং মামলার ভয় থাকে। এক সপ্তাহ যদি এভাবেই যায় তাহলে পেটের চিন্তা করব না ডিজিটাল নম্বর প্লেট লাগাব? কয়েক দফা ঘুরে সমাধান না পেয়ে এখন আর মোটরসাইকেলই চালাই না। বিআরটিএ অফিসের ভোগান্তিতে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। আসলে ভোগান্তির অপর নাম হলো বিআরটিএ অফিস।
এমন অনেক ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ডিজিটাল নম্বর প্লেট, ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে এসে তাদের পড়তে হয় নানা ভোগান্তিতে। তবে দালাল ধরলে সব সুন্দরভাবে সঠিক সময়ে পাওয়া যায়। নিয়ম অনুযায়ী এসব সেবা নিতে গেলে সময় ও কর্ম দু'টোই নষ্ট হয়।
কথা হয় বাস ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী মো. কবিরের সঙ্গে। তার গ্রামের বাড়ি কালকিনি উপজেলার কালীগঞ্জ এলাকায়। নিজের ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করতে ২০২০ সালে আবেদন করেন তিনি। অনেক কষ্ট করে তিনি ২০২২ সালের ১০ মে লাইসেন্স হাতে পান। কিন্তু তার লাইসেন্সে নাম ভুল হয় যা ঠিক করতে এই টেবিল ওই টেবিল করে সময় নষ্ট করতে হচ্ছে তাকে। নিয়ম অনুযায়ী তিনি কোনো সেবা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন।
পেশাদার ট্রাকচালক শাহজালাল বলেন, বিআরটিএ-এর কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালালদের কারণে সেবাগ্রহীতাদের ভোগান্তি পোহাতে হয়।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, দালাল ছাড়া লাইসেন্স পাওয়ার চেষ্টা করাটাও যেন এক ধরনের পাপ। বিআরটিএ-তে সেবা পেতে ভোগান্তিতে পড়ে নিতে হয় দালালের সহযোগিতা। দালাল আর টাকা ছাড়া এখানে কোনো কাজ হয় না।
ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে এসেছেন মোহাম্মাদ রনি। তিনি প্রায় তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর নিয়ম অনুযায়ী লাইসেন্স হাতে পেয়েছেন। তিনি বলেন, অনেকেই টাকা দিয়ে আগে নিয়ে গেছে। আর কত কষ্ট দেবে বিআরটিএ। রাস্তায় গাড়ির কাগজপত্র ঠিক না থাকলে পুলিশ হয়রানি করে। আর বিআরটিএ কাগজ সঠিক সময়ে না দিয়ে আরেক হয়রানিতে ফেলে।
মাদারীপুর বিআরটিএ অফিসের সামনে বসে কাগজ লিখেছেন বাবুল নামের এক লোক। তিনি বলেন, আমরা যারা কাগজপত্র লিখতে পারে না তাদের লিখে দিয়ে সাহায্য করি। এতে তারা খুশি হয়ে আমাদেরকে দু-একশ টাকা দেয়।
এদিকে ‘দালাল ও প্রতারক হতে সাবধান’ এমন সতর্কবার্তা লেখা সাইনবোর্ড চোখে পড়ে মাদারীপুরের বাংলাদেশ সড়ক পবিরবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) গেট দিয়ে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে। শুধু প্রবেশ ফটকেই নয়, এমন সতর্কবার্তা লেখা আরও অনেকগুলো সাইনবোর্ড সাঁটানো আছে মাদারীপুর বিআরটিএ অফিসের বিভিন্ন ভবনের দেয়ালে। কিন্তু এই সতর্কবার্তাকে ছাপিয়ে, বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দালালদের আধিপত্য পুরো বিআরটিএ জুড়ে। এদিকে ভুক্তভোগী অনেকেই দালালদের নাম প্রকাশ করতে ভয় পান। যদি তাদের কাগজপত্র বা লাইসেন্স আটকে দেয় এই ভয়ে অনেকেই মুখ খুলতে চান না।
মাদারীপুর বিআরটিএ অফিসে কর্মরত সহকারী পরিচালক নুরুল হোসেন বলেন, সাধারণ মানুষের অভিযোগগুলো পুরোপুরি ঠিক না। ভেতরে আমাদের কোনো অসঙ্গতি নেই। নিয়ম অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্স, নম্বর প্লেট বা অন্যান্য কাগজপত্র ডেলিভারি হয়। যদি আমাদের অফিসের কেউ এই অসঙ্গতিপূর্ণ কোনো কাজ করে থাকে তাহলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাকিব হাসান/আরকে