উত্তরের জেলা নীলফামারীতে শিল্পকারখানা ও জনবসতি বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে অগ্নিকাণ্ডসহ অন্যান্য দুর্ঘটনার হার। কিন্তু জেলার আটটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে বাড়েনি প্রযুক্তিগত সক্ষমতা।

জনবল সংকট ও পানির উৎস না থাকায় বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলা করতে হিমশিম খেতে হয় ফায়ার ফাইটারদের। এ অবস্থায় আগুন নেভানো ও উদ্ধার অভিযান চালাতে গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিস স্টেশন কর্তৃপক্ষকে।

জানা গেছে, জেলার সৈয়দপুর শহরে রয়েছে বিসিক শিল্পনগরী। এছাড়াও এ জেলায় ১ হাজার ৯৭৫টি শিল্পকারখানা রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ক্ষুদ্র পোশাক কারখানা, হালকা প্রকৌশল, প্লাস্টিক, পলিথিন, চিপসসহ খাদ্যপণ্য, জুতা, প্লাইউড, সিরামিক, তৈজসপত্র, কাগজের মিল ও পাটপণ্য তৈরির প্রতিষ্ঠান। ফলে প্রচুর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে নীলফামারীতে। কিন্তু সে অনুপাতে বাড়েনি ফায়ার সার্ভিস বিভাগের দক্ষ জনবল ও আধুনিক সরঞ্জাম।

নীলফামারীতে আটটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন রয়েছে। সেগুলো নীলফামারী সদর, ডোমার, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ, সৈয়দপুর, উত্তরা ইপিজেড ও চিলাহাটিতে। এর মধ্যে সদর, সৈয়দপুর ও উত্তরা ইপিজেড ফায়ার স্টেশনগুলো ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত। বাকি পাঁচটি বিভিন্ন ক্যাটাগরির।

জেলা ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, গত পাঁচ বছরে জেলার কারখানায় ১৩০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণহানি হয়েছে ৭ জনের। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন ১৩ জন। আর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৫০ কোটি টাকার বেশি।

জেলা ফায়ার সার্ভিসের দেওয়া পরিসংখ্যানে জানা যায়, জনবল কাঠামো অনুযায়ী সদর ও সৈয়দপুরে ৩৯ জন, উত্তরা ইপিজেডে ৩২ জন, ডোমারে ২৪ জন, চিলাহাটিতে ২৪ জন, ডিমলায় ১০ জন, কিশোরগঞ্জে ১৪ জন, জলঢাকায় ১৪ জন এবং নীলফামারী উপ-সহকারী পরিচালকের কার্যালয়ে ৫ জন ফায়ার ফাইটার আছেন। এ নিয়ে মোট ২০১ জন ফায়ার ফাইটার থাকার কথা থাকলে বর্তমানে জেলার আটটি স্টেশনে ১৭৮ জন রয়েছেন। জলঢাকা, সৈয়দপুর ও নীলফামারী সদরে অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও বাকি পাঁচটিতে অ্যাম্বুলেন্স নেই। আগুনে দগ্ধ ফায়ারম্যান কিংবা আগুনে দগ্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের হাসপাতালে নিতে বিপাকে পড়তে হয়।

সৈয়দপুর পৌর শহরের মুন্সিপাড়ার কলেজছাত্রী নওশীন আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ২ মার্চ আমাদের পাশের বাসায় আগুন লাগলে স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস অফিসে খবর দেওয়া হয়। কিন্তু জনবল সংকট ও ভেতরে গাড়ি ঢুকতে না পারায় চারটি বাসা পুড়ে ছাই হয়। এ সময় আগুন নেভাতে প্রয়োজনীয় পানির উৎস না থাকায় ফায়ার সার্ভিসের লোকজনদের বেগ পোহাতে হয়েছিল।

ডিমলা উপজেলার খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের উত্তর খড়িবাড়ী গ্রামের আব্দুল মোতালেব ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত মাসের শুরুর দিকে আমার এক সঙ্গে তিনটি বাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই হয়। কিন্ত জনবল সংকট ও ভিতরে গাড়ি ঢুকতে না পারায় সব শেষ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তিনটি উপজেলা বাদে বাকি পাঁচ উপজেলার বেহাল দশা। নেই জাম্বু কুশন, ড্রাইভিং অ্যাপারেটাস, এয়ার কম্প্রেসার মেশিন, ভেহিক্যাল গাড়ি, পোর্টেবল পাম্প, বিদ্রিং অ্যাপারেটাস ও স্মোক ইজেক্টরসহ এসবের কিছুই নাই। এজন্য বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হিমশিম খেতে হয়। ‘এ’ শ্রেণির স্টেশনগুলোয় যেসব যন্ত্রপাতি আছে তাতে তিন-চারতলা বাড়িতে আগুন নেভানো কঠিন হয়ে পড়ে।

সৈয়দপুর ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার খুরশীদ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, জনবসতি বেড়ে যাওয়ায় এখন অগ্নিকাণ্ড বেড়েছে। সে হিসেবে আগুন নেভানো ও উদ্ধারকাজে ব্যবহৃত আধুনিক যন্ত্রপাতির সঙ্কট আছে। জনবল যা ছিল তার মধ্যে একজন চালকসহ ৬ জন ফায়ার ফাইটারকে জেলার অন্যান্য স্টেশনে সংযুক্তি করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সৈয়দপুর একটি ঘনবসতির শহর। অর্ধশতাধিক বড় ধরনের ফ্যাক্টরি রয়েছে এ শহরে। তাছাড়া বিসিক শিল্পনগরী, রেলওয়ে কারখানা, সেনানিবাস, অর্ধ ডজন বড় বড় মার্কেট এবং ৫ শতাধিক ক্ষুদ্র গার্মেন্টস শিল্প। কিন্তু শহরের মাঝে নেই কোনো পানির জলাধার বা রিজার্ভার। এর ফলে শহরে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়।

ডিমলা ফায়ার স্টেশনের টিম লিডার মোজাম্মেল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগের চেয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা অনেক বেড়েছে। তবে উপজেলাগুলোতে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়েনি। আগুন নেভানো ও উদ্ধারকাজে ব্যবহৃত আধুনিক যন্ত্রপাতির সংকট আছে। জনবল যা আছে, তা পর্যাপ্ত নয়। বড় দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে হিমশিম খেতে হয়। অগ্নিনির্বাপণ কাজের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ডিমলা ফায়ার স্টেশনে পানিবাহী গাড়ি, ভেহিক্যাল গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স দরকার। দীর্ঘদিনেও তা ব্যবস্থা করা হয়নি।

জনবল সঙ্কটের কথা স্বীকার করে নীলফামারী জেলা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক এনামুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেলার পৌর শহরগুলোর কিছু কিছু মহল্লায় আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। অপরদিকে গ্রামের সড়কগুলো প্রশস্ত না হওয়ায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না। ‘সি’ শ্রেণির স্টেশনগুলো ‘বি’ এবং ‘বি’ শ্রেণির স্টেশনগুলোকে ‘এ’ শ্রেণিতে উন্নীত করে প্রয়োজনীয় জনবল ও সরঞ্জাম দেওয়া হলে নানাবিধ সমস্যার সমাধান হবে নিশ্চিত।

শরিফুল ইসলাম/আরকে