কারখানায় কাজ করছে পারভেজ

বয়স যখন সাত বছর, তখন থেকেই কোমল হাতে ধরতে হয়েছিল পরিবারের হাল। অথচ যে বয়সে পড়াশোনা করার কথা, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা কিংবা দুষ্টুমিতে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখার কথা, সেই বয়সেই পারভেজ (১২) কাজ করছে শ্রমিকের।  ভাগ্যবঞ্চিত এমন অনেক শিশু পরিবারের একমাত্র অবলম্বন হয়ে ওঠে। এতে তাদের জীবন নেমে আসে অন্ধকার।

সুবিধাবঞ্চিত শিশু পারভেজের বাবা অসুস্থ, মা কাজ করেন মানুষের বাড়িতে। বাবার চিকিৎসা খরচ আর সংসারের বোঝা তার মাথায় চেপেছে পারভেজের। তাই এই বয়সে কার্টনের কারখানায় কাজ করে সংসারের হাল ধরতে বাধ্য হয়েছে সে।

পারভেজ নাটোর সদর উপজেলার রেল কলোনি এলাকার ফজলুর রহমানের ছেলে। তাদের বাড়ি সরকারি রেলের জায়গায়। নিজস্ব কোনো জমিজমা নেই। পারভেজ কেবল কারখানায় কাজ করে না, লেখাপড়াও করে। সে স্বপ্নকলি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে।

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় পারভেজের। সে জানায়, সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত সে ক্লাস করে। এরপর কার্টনের কারখানায় কাজ করে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এই বয়সে কেন কাজ করে, জানতে চাইলে সে জানায়, পরিবারের অন্য সদস্যদের আয়ে কোনোমতে সংসার চলে। তা ছাড়া বাবা অসুস্থ। তার চিকিৎসার খরচও তো রয়েছে।

তারা দুই ভাই, এক বোন। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। আর ছোট ভাইয়ের বয়স দুই বছর। পারভেজ মেজ, তাই তাকেই পরিবারের হাল ধরতে হয়েছে।

সে কাঁদো কাঁদো চোখে আরও জানায়, আমি ছোট, আমার বোন বড়। স্কুলে পড়তেও ভালো লাগে, কাজ করতেও ভালো লাগে। আমি কারখানায় মাল দাগ দিই, কার্টন টানি, মাল বান্দি আর মাসে ১ হাজার ২০০ টাকা বেতন পাই। আমি দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করি। মাকে সাহায্য করার জন্য কাজ করতে হয়। আমি স্বপ্নকলি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি।

পারভেজের বাবা ফজলুর রহমান জানান, আমি অটোরিকশা চালাই। ৭-৮ বছর আগে আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ঘা হয়। আর তখন থেকেই চিকিৎসা করতে হচ্ছে। ঠিকমতো রিকশা চালাতে পারি না। কষ্ট হয়। তিনি আরও জানান, শারীরিক অবস্থা খুব বেশি ভালো না হওয়ায় নিয়মিত রিকশা চালাতে পারি না। 

পারভেজের মা পারভিন মানুষের বাড়িতে কাজ করেন। মাসিক ১০০০ থেকে ২০০০ টাকা মজুরি পান। তিনি জানান, আমার ছোট ছেলেটা কারখানায় কাজ করে। পরিবারে মানুষ বেশি হয়ে গেছে। ছেলের বাবার শরীরে ঘা হয়েছে ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। এ জন্য আমার ছেলে কারখানায় কাজ করে। পাশাপাশি স্কুলেও যায়। এভাবেই আমাদের সংসার চলে, আমরা গরিব মানুষ। চিকিৎসা করব নাকি সংসার চালাব? এ জন্য আমরা ছোট ছেলেকে ওই কার্টন ঘরে কাজে দিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, নিজস্ব কোনো জায়গা নেই। সরকারি রেলের জায়গা বাস করছি। আমি সরকারের কাছে সাহায্য চাই। আমরা ভালো পরিবেশ ও ভালোভাবে চলাফেরা করতে চাই। সরকার যদি একটা বাড়ি দিত এবং আমাদের দিকে একটু নজর দিত, তাহলে আমরা স্বচ্ছন্দে জীবন যাপন করতে পারি।

হ্যাপি ড্রিমস ফাউন্ডেশনের সভাপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সৈকত ঢাকা পোস্টকে জানান, পারভেজ আমাদের স্কুলেরই ছাত্র। যখন আমরা স্কুল শুরু করেছিলাম ২০১৫ সালে। তখন স্টেশনে যখন আমরা শিশুদের স্কুলে ভর্তি করছিলাম, তখন পারভেজকে কার্টনের কারখানায় কাজ করতে দেখি। এরপর ওর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে স্কুলে ভর্তি করি শিশু বিকাশ শ্রেণিতে। এখন সে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে তার পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করে যেতে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, তার পরিবারের বাবা-মা সবাই অসুস্থ। তার মা বাসাবাড়িতে কাজ করেন। তার পরিবারকে মূলত সহযোগিতা করার জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি যতটুকু সময় পায়, সবটুকু সময় সে খেলতে না গিয়ে কারখানায় কাজ করে। যদি সরকার বা স্বহৃদয়বান কোনো ব্যক্তি তাদের পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ায়, তাহলে পারভেজ পড়াশোনার পাশাপাশি অন্য সব শিশুর মতো বেড়ে উঠতে পারত।

এনএ