মনোহরদী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেট দিয়ে ঢুকতেই কয়েকজন নারীকে দেখা গেল। তাদের চলাফেরা সন্দেহজনক। মিনিট দশেকের মধ্যে তারা উধাও। একটু পর তাদেরই একজনকে দেখা যায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে।রোগী বিক্রি করাই  হচ্ছে এদের প্রতিদিনের কাজ। প্রাইভেট হাসপাতালের হয়ে কমিশনে কাজ করছেন এসব দালাল চক্র।

ডাক্তার সংকট, দালালের দৌরাত্ম্য প্রাইভেট হাসপাতালের প্রতি ডাক্তারদের ঝুঁকে যাওয়াসহ নানান সমস্যায় জর্জরিত মনোহরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। আর এসব কারণেই এখানকার মানুষ দেখে আসছেন মনোহরদী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তারের চেয়ে দালালের সংখ্যা বেশি।

জেলা সদর থেকে মনোহরদীর দূরত্ব ৩২ কিলোমিটার। ১৯৩.৬০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই উপজেলায় প্রায় ২ লাখ ৮৪ হাজার ৬৬৩ জন মানুষ বসবাস করে। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া, নরসিংদীর বেলাব ও কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়াসহ বেশ কিছু এলাকার রোগী আসে এখানে।  মনোহরদী হাসপাতালে ৫০ শয্যা থাকার কথা থাকলেও মোট শয্যা পাওয়া যায় ১৯ টি। বারান্দা ও সিঁড়ির নিচে রাখা হয়েছে বাকিগুলো। এর মধ্যে কয়েকটিতে রোগীও আছে।

৩১ জন ডাক্তারের মধ্যে শূন্য পদ ১৮ টি । বাকি ১৩ জনের মধ্যে  মেডিকেল অফিসার আছেন ৬ জন। এর মধ্যে দুইজন ছুটিতে । ৪ জন মেডিকেল অফিসারের ওপর ভর করে আছে এই হাসপাতাল। এছাড়াও সরকারি এই হাসপাতালের পাশেই রয়েছে ৭ টি বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতাল। ওই সব হাসপাতালের দালালরা কাজ করে কমিশনের বিনিময়ে। রোগী নিয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে ঢুকলেই পান নগদ টাকা।

কথা হয় হাসপাতালের অফিস সহায়ক আবুল কালামের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রতিদিন ২০-২৫ জন দালাল হাসপাতালের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে। রোগীর চাপ থাকলে দালালের সংখ্যাও বেশি থাকে। তারা এখান থেকে রোগী টেনে প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। দালালদের বেশির ভাগই নারী। আশেপাশের গ্রামগুলোতে যারা ফার্মেসি চালায় তারাও এলাকার রোগী নিয়ে আসে কমিশনের বিনিময়ে।

সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালে ডাক্তারের রুমের সামনে রোগীর লম্বা লাইন। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে আছে দেড়ঘন্টা ধরে। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। মাত্র ৪ জন মেডিকেল অফিসারের ওপর ভর করে আছে পুরো হাসপাতাল। দোতলায় ওঠতেই ডেলিভারি রুমের সামনে পানি জমে আছে। পানির সঙ্গে জুতোর ময়লা মিশে একাকার। বেডগুলো অপরিষ্কার, দেয়ালের কার্নিশ বেয়ে ছাদের পানি পড়ে সবসময়।

কথা হয় দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন রোগীর সঙ্গে। কোহিনুর বেগম নামে এক নারী চার মাসের শিশুকে নিয়ে এসেছেন ডাক্তার দেখাতে। কাকে দেখাবেন কিছুই জানেন না তিনি। বললেন, ডা. আছেন একজন। সবাই লাইন ধরছে, তাই আমিও ধরছি। দেড়ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। বাচ্চা কোলে করে এতক্ষণ দাঁড়ানো যায় না। যদি বেশি ডাক্তার থাকতো অথবা ছেলে মেয়ে আলাদা লাইনের ব্যবস্থা থাকতো তাহলে কষ্ট কমতো।

নোয়ানগর ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক সালাউদ্দিন মোড়ল দাঁড়িয়ে ছিলেন লাইনে। সাংবাদিক পরিচয় শুনে নিজ থেকেই বললেন, এভাবে হাসপাতাল চলতে পারেনা। ডাক্তার নাই, রোগীর লাইন লেগে থাকে। অনেকগুলো বেড বাইরে পড়ে আছে। দালালদের দৌরাত্ম্য তো আছেই। তারা রোগীদের প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে কমিশনের বিনিময়ে। আবার অনেক রোগী অতিষ্ঠ হয়ে নিজেই প্রাইভেট ক্লিনিকের দিকে ঝুঁকছেন।

আয়েশা বেগম নামে একজন বলেন, গত সপ্তাহে এসে ডাক্তার দেখাতে পারিনি । লাইনের রোগী শেষ না করেই ডাক্তার চলে গেছেন। আজকে আবার এসেছি, তাও লম্বা লাইন। পায়ের ব্যাথায় দাঁড়াতে পারিনা। এভাবে কতদিন চলবে।

হাসপাতালের সার্বিক সমস্যা নিয়ে কথা হয় মনোহরদী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: শামীম আহমেদের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমার পক্ষে একা দালাল ঠেকানো সম্ভব নয়। তাছাড়া এখানে ভবন নেই। নির্মাণাধীন ভবন রয়েছে একটি । তার কাজও ধীরগতিতে চলছে ।

আয়া আছে দুইজন, ডাক্তার থাকার কথা ৩১ জন। আছে মাত্র ১৩ জন। এর মধ্যে আবার দুইজন ছুটিতে। শূন্য পদ রয়েছে ১৮ টি। এই অল্প সংখ্যক ডাক্তার প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজারের বেশি মানুষকে সেবা দিচ্ছে। নতুন ডাক্তার যোগদান করলেও বসার জায়গা নেই। নতুন ভবন নির্মাণ হলে সমস্যা থাকবে না ।

নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ দেখতে গিয়ে দেখা যায় এখনও ১০ শতাংশ কাজ হয়নি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা মার্কেন্টাইল কর্পোরেশনের ম্যানেজার শরিফুল ইসলাম বলেন, আগস্ট মাসে কাজ শুরর কথা থাকলেও বিভিন্ন জটিলতার কারণে কাজ শুরু করতে হয়েছে নভেম্বর মাসের শেষের দিকে। চার তলা এই ভবনের কাজ করোনার থাবায় স্থবির হয়ে গেছে। তবে এক বছরের মধ্যে কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি।

শয্যা কম, ডাক্তার সংকট এবং দালাল সমস্যা বিষয়ে নরসিংদীর সিভিল সার্জন ডা.নুরুল ইসলাম বলেন, পুরাতন একটি ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে । যার ফলে ৫০ শয্যার হাসপাতাল হলেও সবগুলো শয্যা কাজে লাগানো যাচ্ছেনা। নতুন ভবনের কাজ শেষ করে ওঠতে দেড়বছর লাগবে। আশা করি তখন ৫০ শয্যাই কাজে লাগাতে পারবো।

তিনি আরো বলেন, ডাক্তার সংকটের বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে । দালালের বিষয়টা দুঃখজনক। এটা প্রতিরোধে আমরা আগে থেকেই সোচ্চার ছিলাম। এখনও আছি। তবুও তাদের দৌরাত্ম্য আছে। পুলিশি অভিযান চালাবো । আশা করি কিছু দিন পর এটাও থাকবেনা।

এমআইএইচ