শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মাইকেল ঢালী। তিনি পেশায় একজন রিকশাচালক। রিকশা নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সকলের খোঁজখবর নিয়ে গরিবের বন্ধু হয়ে উঠেছেন মাইকেল। 

গত বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনে জনগণের ভোটে নড়িয়ার মোক্তারের চর ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ওই বছরের মার্চ মাসে ইউপি সদস্য হিসেবে শপথ নেন। ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার এক বছর পেরিয়ে গেলেও মাইকেল রিকশা চালিয়ে এখনো নিজের পরিবারের ভরণপোষণের পাশাপাশি এলাকার প্রত্যেকের বিপদে-আপদে পাশে থাকেন। প্রায় ১০ বছর ধরে ভাঙা একটি রিকশা চালিয়ে কোনো মতো নিজের দিন পার করলেও হাতে কিছু টাকা জমলেই তিনি জনগণকে সহযোগিতাসহ রাস্তাঘাট ভেঙে গেলে তা মেরামত করে দেন। মাঝে মধ্যে অসুস্থ রোগীকে করেন আর্থিক সহযোগিতা।

মোক্তারের চর ইউনিয়নের পোড়াগাছা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রব ঢালী ও নিলুফা বেগম দম্পতির আট সন্তানের মধ্যে মাইকেল সবচেয়ে বড়। নিজের ভিটেমাটি ছাড়া কোনো কৃষিজমি না থাকায় অভাবের সংসারে বড় হন মাইকেল। কিশোর বয়সে বাবা-মাকে হারান তিনি। গ্রামের পঞ্চায়েত বাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর অভাবে আর স্কুলে যেতে পারেননি। এর কয়েক বছর পর ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে দীর্ঘ ১০ বছর ডিঙি নৌকা চালিয়ে প্রায় ১৫ বছর আগে গ্রামে ফিরে আসেন তিনি। গ্রামে ফেরার পর আবার অভাবে পড়েন।  মা-বাবা ভালোবেসে মাসুম নাম রাখলেও যৌবন বয়সে প্রিয় একটি নাটকের চরিত্র মাইকেলের নামানুসারে নিজের নাম রাখেন ‘নিউ মাইকেল’। এরপর থেকে এলাকায় নিউ মাইকেল ঢালী নামে পরিচিত তিনি।

জানা যায়, মাইকেল কয়েক বছর আগে এলাকার গরিব লোকদেরকে চাল অনুদান দিতে অনুরোধ করেন এক জনপ্রতিনিধিকে। কিন্তু ওই জনপ্রতিনিধি গরিব লোকদের সাহায্য না করে একটু সচ্ছল ব্যক্তিদের সাহায্য করায় আঘাত লাগে মাইকেলের মনে। এরপর অভিমানে নিজেই রিকশা চালিয়ে গরিব-অসহায়দের সহযোগিতা করতে থাকেন। যখন প্রথমে এই সাহায্য শুরু করেন তখন তার লক্ষ্য ছিল গরিবের মুখে হাসি ফুটানো। এভাবে মানুষকে সাহায্য করতে করতে একদিন এলাকার সব গরিব- অসহায় মিলে মাইকেলকে ইউপি সদস্য হওয়ার প্রস্তাব করেন। নির্বাচনে প্রভাবশালী প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গ ২০১৬ সালে হেরে গেলেও মাইকেল গত বছর নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার পরও মাইকেল তার রিকশার হ্যান্ডেল ছাড়েননি। এখনো প্রতিদিন তিনি ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা বেশি সময় রিকশা চালিয়ে উপার্জন করে এলাকার বৃদ্ধ, অসুস্থ, গরিব মানুষকে সহযোগিতা করেন।

পোড়াগাছা এলাকার বাসিন্দা বৃদ্ধ আমেনা বেগম বলেন, মাইকেল গরিবের মেম্বার। তিনি রাত-বিরাতে একালার অসুস্থ-বৃদ্ধ মানুষের পাশে থাকেন। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে যিনি সাহায্য পাওয়ার যোগ্য তাকেই তিনি সাহায্য করেন। গরিবের হক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার কারণে।

আরেক অসহায় নারী কহিনুর বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাইকেলের কোনো জায়গা-জমি নেই। রিকশা চালিয়ে উপার্জন করে সে। তাকে ভোট দিয়ে মেম্বার বানিয়েছি। কয়েকদিন আগের ঝড়ে তিনি মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিড়া, মুড়ি, মোমবাতি দিয়েছেন। গত ঈদে সবাইকে সেমাই চিনি দিয়েছেন। তার টাকা না থাকার কারণে তিনি লোন করে টাকা নিয়ে এসবের টাকা যোগাড় করেছেন।

করিম হাওলাদার কয়েক বছর আগে ব্রেইন স্ট্রোক করে বর্তমানে অসুস্থ। তার পাঁচ মেয়ে। কোনো ছেলে সন্তান নেই। এতদিন কোনো সাহায্য সহযোগিতা পেতেন না। মাইকেল মেম্বার হওয়ার পর করিম হাওলাদারকে প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল, তেল, ডাল সহযোগিতাসহ তার ওষুধ খরচের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। 

করিম হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাঁচটা মেয়ে নিয়ে আমি খুব অসহায় ছিলাম। গরিব মানুষ মেম্বার হওয়ার কারণে আমি সহযোগিতা পেয়েছি।

স্থানীয় বাসিন্দা হাবিব ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাইকেল ভাই মেম্বার হওয়ার পর এলাকার গরিব অসহায় মানুষ অনেক শান্তিতে আছে। তাদের প্রাপ্য তারা ঠিক মতো পাচ্ছে। তরুণরা শান্তিতে আছে। কোনো ঝামেলায় নাই তিনি। সহজ-সরল এমন জনপ্রতিনিধি পেয়ে আমরা আনন্দিত।

আব্দুল কাদের ছৈয়াল বলেন, আমরা সবাই মিলে ভোট দিয়েছি। গরিব মানুষ বলে আমরা ৩০ টাকার ভাড়া ২০টাকা দিলেও মাইকেল কিছু বলেন না। সবাইকে সুন্দরভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন।

রিকশাচালক কামাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাইকেল ভাই আমাগো রিকশা-ভ্যান চালকগো মেম্বার, গরিবের মেম্বার। আমরা সবাই মিলে অনুরোধ করে তাকে মেম্বার বানিয়েছি। কোথাও রাস্তাঘাট ভেঙে গেলে তিনি নিজের টাকায় বাঁশসহ প্রয়োজনীয় সরাঞ্জম কিনে ভাঙা রাস্তা ঠিক করে দেন। রিকশাচালক মেম্বার হওয়ায় তাকে যখন তখন পাওয়া যায়।

বৃদ্ধ রুবিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম মাইকেল মেম্বারের অপেক্ষায়। ওয়ারিশ সার্টিফিটের জন্য। তিনি রিকশায় বসেই স্বাক্ষর করে দিয়েছেন। যখন তখন এই মেম্বারকে কাজে পাই আমরা।

মাইকেলের স্ত্রী লিপি বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা গরিব মানুষ। সংসারের প্রথম থেকেই দেখেছি মাইকেল গরিব মানুষদের নিয়ে চিন্তিত থাকতেন। গরিবকে ভালোবাসেন বলেই গরিবরা তাকে ভোট দিয়েছেন। সংসারে কোনো কিছু প্রয়োজন হলে তিনি তা যোগাড় করার চেষ্টা করেন। তবে অবশ্যই নিজের থেকে অন্য কেউ বেশি সমস্যাগ্রস্থ কিনা তা আগে খেয়াল রাখেন।

তিন সন্তানের জনক মাইকেল ঢালী। বড় মেয়ে আসমা আক্তারকে বিয়ে দিয়েছেন। মেজো মেয়ে শান্তা মনি স্থানীয় একটি মাদরাসার আলিম প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। একমাত্র ছেলে আকাশ ঢালী কালু বেপারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। রিকশা চালিয়ে ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চান মাইকেল।

মোক্তারের চর ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের  ইউপি সদস্য মাইকেল ঢালী ঢাকা পোস্টকে বলেন, গরিব মানুষ আমি। গরিবের কষ্ট দেখে খারাপ লাগে। গরিবকে সহযোগিতা করার জন্যই তাদের অনুরোধে নির্বাচন করেছি। রাত-বিরাত যখনই তারা সমস্যায় পড়েন আমি তাদের পাশে থাকি। নিজের ভিটেমাটি ছাড়া কোনো জমি নেই বলে রিকশা চালাই। রিকশা দিয়ে গরিবকে ফ্রিতে হাসপাতালে নিয়ে যাই। গরিব মানুষ আমাকে ভালোবেসে ভোট দিয়েছে। আমার নিজের থাকার মতো ঘর নেই। আমার মতো আরও অনেকেরই ঘর নেই। আমি সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে চাই।

মোক্তারের চর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. বাদশাহ শেখ ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত নির্বাচনে মাইকেলসহ পাঁচজন প্রার্থী ৬ নম্বর ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গরিব প্রার্থী ছিল মাইকেল। জনগণ তাকে ভালোবেসে নির্বাচিত করেছেন। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে প্রাপ্ত সকল প্রকার সহযোগিতা তিনি মানুষকে তার রিকশা দিয়ে বাড়িতে গিয়ে পৌঁছে দেন।

নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শংকর চন্দ্র বৈদ্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাইকেলের মতো দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী মানুষের জনপ্রতিনিধি হওয়ার নজির কম। মাইকেল ইউপি সদস্য হওয়ার পরও তার জীবিকার মাধ্যম রিকশা চালানো ছাড়েননি। তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে খুবই ভালো ধারণা পেয়েছি। তার এই কাজকে উপজেলা প্রশাসন সাধুবাদ জানায়। স্থানীয় প্রশাসন তার পাশে থাকবে।

আরএআর