এক যুগের বেশি সময় ধরে নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন সুনিলা বিশ্বাস (৪২)। স্বামী মারা যাওয়ার পরে সংসার চালানোর জন্য নদীই তার একমাত্র ভরসা। জালে মাছ উঠলে ঘরে উনুন জ্বলে না হলে অর্ধাহারে আর অনাহারেই দিন কাটে মা-ছেলের। ২০১৪ সালে একটি জেলে কার্ড পেলেও আজ অবধি কার্ডের বিপরীতে কোনো সরকারি সেবা পাননি তিনি।

তবে এমন দৃশ্য শুধু বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার বারুইপাড়া এলাকার সুনিলা বিশ্বাসের পরিবারেই নয় জেলার সদর, রামপাল ও কচুয়া এই তিন উপজেলার অন্তত দেড় হাজার জেলে পাননি কোনো ধরনের সরকারি সহায়তা।  

সুনিলা বিশ্বাস বলেন, রোদ, ঝড় বৃষ্টি , অমাবশ্যা পূর্ণিমা মাথায় নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দিতে দাউদ খালি নদীতে জাল ধরে জীবিকা নির্বাহ করছি। এখন সরকার মাছ ধরতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তো কি খাব এখন? গত ২০১৪ সালে সরকারি সহযোগিতার একটি জেলে সহায়তা কার্ড পাই তবে গত ৯ বছরে সহায়তা হিসেবে কিছুই পাইনি। না পাই কোন সরকারি সেবা। আর বিধাব কার্ডের জন্য চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা খালি আশ্বাস দেয়। এভাবে পার হইছে এক যুগের বেশি সময়। 

তার মতো আরও বেশ কয়েকজন নারী এই নদীতে জাল ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন নদীতে মাছ ধরা বন্ধ থাকলেও তাদের খোঁজ রাখে না সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তর।

প্রতি বছর সাগরে ৬৫ দিন এবং সুন্দরবন উপকূলের নদ-নদীতে ১০৪ দিনের নিষেধাজ্ঞার কারণে বেকার থাকে জেলে পরিবারগুলো। এই সময় সরকারি খাদ্য সহায়তা না পাওয়ায় সংসার চলাতে হিমশিম খেতে হয় তাদের। অবরোধকালীন বেকার অনেকে পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দিতে মহাজনদের কাছে দ্বারস্থ হন। ফলে সুদের কারণে ঋণে জর্জরিত হতে হয় তাদের। 

মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জেলায় নিবন্ধিত জেলে সংখ্যা ৩৯ হাজার ৬২৭ জন। যার মধ্যে সমুদ্রগামী জেলের সংখ্যা ১২ হাজার। আর খাদ্য সহায়তা পেয়েছেন ৯ হাজার। এছাড়া সুন্দরবনের উপর সরাসরি নির্ভরশীল ও নদী খালে মাছ ধরা ৬ থেকে ৮ হাজার জেলে খাদ্য সহায়তা পাননি।

রামপালের লক্ষ্মণ পাল বলেন, জন্মের পর থেকেই বৈধভাবে জঙ্গলে মাছ ধরি। সরকার এখন জঙ্গলে যাওয়া বন্ধ করে দিছে। দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির কারণে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে কেউ খবর নেয় না। ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া করাইতে পারছি না। সরকার থেকে একটা জেলে কার্ড দেওয়া হয়েছে কিন্তু কোনোদিন এ কার্ড থেকে কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেলাম না। অনেক জেলেরা শুনছি পায়েছে। আমার অপরাধ টা কী? আমরা ও তো জেলে আমরা কেন পাব না?

চাকশ্রী এলাকার জেলে আব্দুল সত্তার বলেন, নদীতে জাল ধরতে দেয় না। ছেলে-মেয়ে ৪ জন। কয়ডা চাল পেতাম তাও পাই না। শাকপাতা তুলে খেয়ে না খেয়ে দিন যায়। 

শরণখোলা উপজেলার খুড়িয়াখালী এলাকার রশীদ মোল্লা বলেন, ছেলে-মেয়ের স্কুলের খরচ যোগাতে পারি না। আমাদের মেম্বারের কাছে শুনেছি এবার চাল আসেনি। নদীতে জাল ধরতে দেয় না, চালও পাই না। আড়ৎদার ও মহাজনদের থেকে দাদোন নিয়ে কোন মতো চলছি।

বাইতলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফকির আবদুল্লাহ বলেন, আমার ইউনিয়নে ৩০০ জনের বেশি নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। কিন্তু উপজেলা থেকে আমার ইউনিয়নে ২০ জন জেলেকে ২ মণ করে মোট ৪০ মণ ভিজিএফ চাল দেওয়ার তালিকা নেওয়া হয়। সেই অনুসারে বিতরণ করা হয়। এ বছর এখন পর্যন্ত জেলেদের ভিজিএফ চালের বরাদ্দ আসেনি। চাল এলে আমরা নিয়ম অনুযায়ী বন্টন করব।

তিনি আরও বলেন,  যেহেতু জেলে ৩০০ আর বারাদ্দ আসে ২০ জনের তাই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দিয়ে থাকি, যেন সব জেলে সরকারের এই সহায়তা পান।

এ বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এএসএম রাসেল বলেন, বাগেরহাট জেলায় ৩৯ হাজার ৬২৭ জন জেলে রয়েছে। ৬৫ দিনের মৎস্য আহরণ বন্ধ থাকায় মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ এই তিনটি উপজেলায় ৯ হাজার জেলেরা খাদ্য সহায়তা পেয়ে থাকে। এর বাইরে সদর কচুয়া ও রামপাল উপজেলায় দেড় হাজার জেলে আছে যারা এখনো এই মানবিক সহায়তা পায়নি। তাদের এবং সুন্দরবন নির্ভরশীল ৬ হাজার জেলের তালিকা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। আশা করি তারা সহযোগিতা পাবেন।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, ৬৫ দিনের মৎস্য আহরণ বন্ধ থাকায় মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ এই তিনটি উপজেলায় ৯ হাজার জেলে খাদ্য সহায়তা পেয়েছে। বাকি রামপাল কচুয়া ও বাগেরহাট সদরের জেলেরা জেলে কার্ডের সেবা এখনো পায়নি। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকতার সঙ্গে কথা বলা হয়েছে।

শেখ আবু তালেব/আরকে