ফেনীর ফুলগাজী-পরশুরামে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। মুহুরী নদীর বাঁধে ৩টি স্থানে ভাঙনের পর এক এক করে লোকালয় প্লাবিত হচ্ছে। এতে দুই উপজেলার অন্তত ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন বলে জানান উপজেলা প্রশাসন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড ফেনীর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আরিফুর রহমান ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে জানান, অন্যান্যবার বন্যার পানি একবার নেমে গেলে আর বাড়েনি। তবে এবার এ এলাকায় ব্যতিক্রম চিত্র দেখা যাচ্ছে। মঙ্গলবার সকালে মুহুরী নদীর পানি কমে বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও রাতে সেটি বেড়ে বিপৎসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

ফুলগাজী উপজেলার উত্তর দৌলতপুরে ব্রিজ পেরিয়ে কর্দমাক্ত পথের পাশে বাঁধের ভেতরে ছোট্ট একটা ঘরে বসবাস করা বৃদ্ধা ছকিনা তার দুর্ভোগের কথা জানিয়ে বলেন, 'গাঙের ভিতরে থাই, এক্কান ঘর নাই, কোনো ঢাল-কূল নাই। ছেলে-সন্তান নিয়া খুবই কষ্টের মইধ্যে থাই। দ্যাখেন কী অবস্থায় আছি। আন্ডা দিগে যদি একটু চাইতেন'। 

সেখানের অন্য বাসিন্দারা জানান, রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমানোর অবকাশ নেই আমাদের। রাত জেগে পাহারায় থাকতে হয় যদি বাঁধ ভেঙে ভিটেমাটি সব চলে যায় নদীর কবলে।

সোমবার অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে মুহুরী নদীর বাঁধ ভাঙনের কারণে ছকিনাদের মতো জেলার দুই উপজেলার বন্যাকবলিত প্রায় ১৬টির বেশি গ্রামের মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। 

পরশুরাম উপজেলার চিথলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন ভূঞা ঢাকা পোস্টকে জানান, ভাঙনের পরে ইউনিয়নের ধনীকুন্ডা, মধ্যম ধনীকুন্ডা, চিথলিয়া, পশ্চিম অলকা, পূর্ব অলকা, নোয়াপুর, রতনপুর, পৌর এলাকার অনন্তপুর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যাদুর্গতের জন্য ইউপি সদস্যদের মাধ্যমে শুকনো খাবার ও চাল পাঠানো হচ্ছে।

পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দা শমসাদ বেগম জানান, উপজেলার বন্যাদুর্গতদের জন্য ৬০০ প্যাকেট শুকনো খাবার এবং ২ টন চাল বিতরণ করা হচ্ছে। তাদের সহায়তায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কন্ট্রোল রুম ও একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হচ্ছে। 

চিথলিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য এম সফিকুল হোসেন মহিম বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ নির্মাণে ত্রুটিপূর্ণ কাজের কারণে বারবার এ ধরনের ভাঙনের দেখা দেয়। বাঁধে মানসম্মত মাটি ব্যবহার করলে এখানকার এত হাজার পরিবারকে কষ্ট করতে হতো না। এই ধরনের ভাঙনের পর প্রতিবারই পরিদর্শনে এসে বিভিন্ন আশ্বাসের কথা শোনা গেলেও পরে আর কারো খবর থাকে না।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বন্যায় ফুলগাজীতে ৩০০ হেক্টর এবং পরশুরামে ১৬৫ হেক্টর রোপা আমন ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া সবজিখেতও তলিয়ে গেছে।

জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বন্যার পানিতে দুই উপজেলার ৩৭৫টি পুকুর ও ঘেরের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। ক্ষতির চূড়ান্ত পরিমাণ নির্ণয় ও ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের সহযোগিতা করতে মাঠপর্যায়ে মৎস্য বিভাগ কাজ করছে। 

ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানিয়া ভূঁইয়া বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের শুকনো খাবারসহ বরাদ্দের চাল দেওয়া হচ্ছে। বন্যাদুর্গতদের খোঁজখবরের জন্য সার্বক্ষণিক বিভিন্ন টিম মাঠে কাজ করছে।

বৃষ্টি ও নদীর পানি বাড়ার ফলে জেলার সীমান্তবর্তী এ দুই উপজেলায় নদীর ভাঙন দেখা দিলে মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হয় প্রতিবছরই। টেকসই বাঁধ মেরামতের জন্য ৭৩১ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ শুরু হবে নিরীক্ষণ শেষে। নদীতে পানির প্রবাহ কিছুটা কমে এলে ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত করা হবে বলছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। 

এদিকে ফুলগাজীতে বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য শিরীন আক্তার এবং ফেনী পুলিশ সুপার জাকির হাসান। বিকেলে বন্যাদুর্গত এলাকা ঘুরে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করেন তারা।

তারেক চৌধুরী/আরকে