চোখ-হাত বেঁধে গুলি করতে থাকে হায়েনার দল
আজ ৩ এপ্রিল, শনিবার। দখিগঞ্জ গণহত্যা দিবস। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আজকের দিনে রংপুরে ঘটেছিল এক অকল্পনীয় হত্যাযজ্ঞ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রংপুরের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষ জররেজসহ ১১ বাঙালিকে দখিগঞ্জ শ্মশান রংপুর-মাহিগঞ্জ রোডে চোখ ও হাত বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করে।
গুলিবিদ্ধ একজন আরেকজনের ওপর ঢলে পড়েন। নিমিষেই ঝরে যায় তরতাজা প্রাণ। হায়েনার দলের এই হত্যাযজ্ঞে গুলিবিদ্ধ মানুষের স্তূপ থেকে প্রাণে বেঁচে যান একজন। তিনি ছিলেন তাজহাটের দীনেশ চন্দ্র ভৌমিক ওরফে মন্টু ডাক্তার। সেদিন মধ্যরাতের এই নির্মমতা মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর রংপুরে প্রথম গণহত্যার ঘটনা।
বিজ্ঞাপন
আজও কালের সাক্ষী হয়ে আছে রংপুরের দখিগঞ্জ শ্মশান বধ্যভূমি। বর্তমানে সেখানে শহীদদের নাম লেখা একটি স্মৃতিফলক রয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। তবে রংপুরের অন্যতম এই বধ্যভূমি সংরক্ষণ করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত দখিগঞ্জ শ্মশান বধ্যভূমির স্থায়ী সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়নি। সেভাবে পালন করা হয় না দখিগঞ্জ গণহত্যা দিবসটিও। শুধু ৩ এপ্রিল আর ১৬ ডিসেম্বর এলেই শহীদ পরিবারের সদস্যরা সেখানে শহীদদের স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
বিজ্ঞাপন
অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধে রংপুরের মানুষের অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগের ইতিহাসটা অন্যরকম। রংপুরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই পাকিস্তান সরকারের শাসন, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। ৩ মার্চ রংপুরে মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন শিশু শংকু সমজদার। স্বাধীনতার গণআন্দোলন সংগ্রামের প্রথম ‘শিশু শহীদ’ বলা হয় শংকুকে।
২৪ মার্চ ক্যান্টনমেন্ট নিসবেতগঞ্জ এলাকাতে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি জিপ গাড়িতে হামলা করে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে আব্বাসী নামে সেনা সদস্যকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে স্থানীয় শাহেদ আলী নামে এক কসাই।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র একদিন পরই পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য মুখিয়ে থাকা রংপুরবাসী পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি ‘ক্যান্টনমেন্ট’ ঘেরাও করে। সেই দিনের বীরত্বগাঁথা, সাহস আর আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণার পথ ধরেই সূচিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রাম।
এ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে গোটা রংপুর শহরে। বাড়তে থাকে পাকিস্তানি সেনাদের ক্রোধ আর প্রতিশোধের মহড়া। যেন মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই রংপুরে যুদ্ধ শুরু করেছিল মুক্তিকামী দামাল ছেলেরা। ৩ এপ্রিল দখিগঞ্জ শ্মশানে চালানো গণহত্যা ছিল পাকিস্তানিদের প্রতিশোধ নেওয়ার একটি ধাপ।
১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল হঠাৎ করেই মধ্যরাতে দখিগঞ্জ শ্মশানের কাছে গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে আশপাশের মানুষের। ঠিক যেন ২৫ মার্চের কালো রাতের মতোই। রংপুরবাসী কোনো দিন কল্পনাও করতে পারেনি হাত-পা বাঁধা অবস্থায় এমনভাবে বাঙালিদের হত্যা করতে পারে হায়েনার দল। সেদিন সর্বজন শ্রদ্ধেয় অ্যাডভোকেট ইয়াকুব মাহফুজ আলী ওরফে জররেজসহ ১১ জনকে ধরে নিয়ে আসে পাকিস্তানি সেনারা।
জররেজ ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ রংপুর শহরের নবাবগঞ্জ বাজারে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। সেই সাহসী সন্তানসহ ১১ জনকে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় দখিগঞ্জ শ্মশানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করে গুলি চালিয়ে হত্যা করে।
সেই ধ্বংসযজ্ঞের সময় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান দীনেশ চন্দ্র ভৌমিক ওরফে মন্টু ডাক্তার। তিনি গুলি বর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে যান। তার শরীরের ওপর অন্যরা পড়েছিল বলে তার পায়ে গুলি লাগে। এতে হায়েনারাভাবে মন্টু ডাক্তার মারা গেছেন। পাকবাহিনী ওই এলাকা ত্যাগ করার পর কোনোক্রমে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। পরবর্তীতে অন্যদের সহযোগিতায় ভারতে চলে যান তিনি। সেখানে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
৩ এপ্রিলের মধ্য রাতের নারকীয় সেই হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় পরদিনই রংপুরের মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। এ খবর মুহূর্তের মধ্যে সারা জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত মানুষ ছুটে আসে দখিগঞ্জ শ্মশানের দিকে। লাশের স্তূপ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। ওইদিন থেকে পাকিস্তানিদের নির্মমতা থেকে বাঁচতে রংপুরের মানুষ নিরাপদ গন্তব্য খুঁজতে শহরের ঘরবাড়ি ছেড়ে গ্রামে পালাতে শুরু করেন। গ্রাম ছেড়ে আরও নিরাপদ দূরত্বে সীমান্তের ওপারের দেশ ভারতেও চলে যান অনেকেই।
দখিগঞ্জ শ্মশানে পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন-অ্যাডভোকেট ইয়াকুব মাহফুজ আলী ওরফে জররেজ, মোহাম্মদ মহরম, শ্রী গোপাল চন্দ্র, উত্তম কুমার অধিকারী, দুলাল মিয়া, রফিক আলী, সতীশ হাওলাদার, দুর্গা দাস অধিকারী। আরও দুইজনের নাম পরিচয় পাওয়া যায়নি।
রংপুরের মানুষের দাবি, দখিগঞ্জ শ্মশান বধ্যভূমিসহ জেলার প্রতিটি বধ্যভূমিতে একটি করে কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হোক। সরকারিভাবে এখনই উদ্যোগ না নেওয়া হলে আগামী প্রজন্ম জানতেই পারবে না ৩ এপ্রিলের পৈশাচিকতার ঘটনা। অজানা থেকে যাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের আত্মদান।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এসপি