নিজের আবাদের জমি হারিয়ে হতাশ এক কৃষক

শেরপুরের দশানি নদীর ভাঙনে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে চরাঞ্চলের মানুষ। গত দুই দশকে ৭ নম্বর ও ৬ নম্বর চর এলাকায় নদীগর্ভে চলে গেছে শত শত একর আবাদি জমি ও বাড়িঘর। কিন্তু ভাঙন রোধে স্থায়ী কোনো টেকসই ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বছর নতুন করে ভাঙনে ৫০ একর আবাদি জমি, ১০-১২টি বসতবাড়ি ও এক কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন হুমকির মুখে আছে স্থানীয় বাজার, জামে মসজিদ, হাফেজিয়া মাদ্রাসা, শহীদ মিনার, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কবরস্থান। এতে চরম আতঙ্ক আর হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন চরাঞ্চলের মানুষজন।

ছাইফুদ্দিন মন্ডল (৬০)। তিনি শেরপুর সদরের কামারের চর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য। দুই বছর আগে দশানি নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায় তার বসতভিটা ও বাড়িঘর। ফের নতুন করে বাড়ি করেন নতুন জায়গায়। কিন্তু এবারও নদী ভাঙতে ভাঙতে ইতোমধ্যে তার উঠান ও টিউবওয়েল নিয়ে গেছে। এখন টিকে আছে শুধু বসতঘর। যেকোনো সময় তাও নদীতে চলে যাবে।

একই অবস্থা মোহাম্মদ কাইম উদ্দিনের (৬৬)। বাড়ির সামনে দিয়ে হাটে যাওয়ার ১ কিলোমিটার কাঁচা সড়কটি গত দুই সপ্তাহে সম্পূর্ণ নদীগর্ভে চলে গেছে। এখন বসত বাড়ি নদীতে যায় যায় অবস্থায় টিকে আছে। ৭নং চরে গত কয়েক বছর ধরে দফায় দফায় দশানি নদীর ভাঙনে ভিটে মাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকেই। বসতভিটা, কবরস্থানসহ আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।

সম্প্রতি ৭নং চরে গিয়ে দেখা যায়, এবার ভাঙনের তোড়জোর বেশি। গেল এক সপ্তাহেই অন্তত ৫০ একর আবাদি জমি, ১০টি বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদীতে হারিয়ে গেছে গ্রামের প্রায় এক কিলোমিটার কাঁচা সড়ক। প্রতিবছরই নদী ভাঙন দেখা দেয়, কিন্তু দেখা মেলে না পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাউকে। ফসলি জমি ও বাড়িঘর হারিয়ে চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন ভুক্তভোগীরা।

স্থানীয় বাসিন্দা আবু সাঈদ বলেন, ‌‘আমার আব্বার বয়স ৯০। আমার বাড়ি এ নিয়া চারবার নদী লইয়া গেছে। এহন বয়সও শেষ আর জমিও নাই যে, অন্য জায়গায় ঘর তুলমু। জমিও নদীতে চইলা যাওয়ায় আবাদ করার আর জায়গা নাই, অনেক কষ্টে আছি।’

৭নং চরের পূর্ব পাড়ার নওশের ব্যাপারীসহ কমপক্ষে ২৫ জন কৃষকের ফসলি জমি দশানি নদীর গর্ভে চলে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানান, তাদের ফসলি জমি নদীতে চলে গেছে। একরের পর একর জমি এভাবে প্রতিবছর নদীতে বিলীন হচ্ছে। কিন্তু এতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাউকে কোনোদিন দেখা যায় নি। আবাদি জমি হারিয়ে এখন তারা নিঃস্ব। ফসল ফলানোর মতো জায়গা তো নদীতে চলে গেছে, তাই আবাদ করার আর জায়গা নেই। অনেক কষ্টে আছেন তারা। আগুনে পুড়লে তো মাটিটুকু থাকে কিন্তু নদীতে ভাঙলে কিছুই থাকে না।

একই এলাকার আলহাজ শের আলী (৮০)। নদীর গতিপথের ব্যাপারে তিনি বলেন, আগে নদীটি অন্তত বর্তমান অবস্থান থেকে কমপক্ষে দেড়শ ফিট দূরে ছিল। ওপারে নদী ভরাট হয়ে এপারে প্রতি বছর ভাঙছে। ভাঙতে ভাঙতে নদীর গতিপথ পুরো পাল্টে গেছে।

নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে শতশত একর আবাদী জমি

৭নং চরে গিয়ে আরও দেখা যায়, ভাঙ্গনের হুমকিতে আছে ৭নং চর বাজার, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শহীদ মিনার, কবরস্থান, হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে নব নির্মিত দুইতলা জামে মসজিদ। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে যেকোনো সময় নদীগর্ভে চলে যাবে এসব প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নদীতে ভেঙে গেলে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হবে প্রত্যন্ত এ পল্লির নতুন প্রজন্ম।

চর বটতলা বাজারের ব্যবসায়ী পল্লি চিকিৎসক বাদশাহ মিয়া বলেন, দীর্ঘ ৩৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী আমাদের এ বাজারটি। স্থানীয় বিভিন্ন চরের মানুষ এখানে আসে বেচাবিক্রি করতে। কিন্তু দশানি নদীটি এখন বাজার হতে মাত্র ১০০ ফিট দূরে আছে এবং ভাঙন অব্যাহত আছে। জরুরি একটা ব্যবস্থা না নিলে যেকোনো সময় বাজারটি নদীগর্ভে চলে যাবে।

আরেক পল্লি চিকিৎসক জহুরুল হক বলেন, ঐতিহ্যবাহী বাজারটি তিন যুগ ধরে আশেপাশের কয়েক হাজার মানুষের বেচাকেনার কেন্দ্রস্থল। এ বছর নদীর ভাঙনের তোড়জোড় খুব বেশি। নদীটি বাজারের কাছাকাছি এসে গেছে। দ্রুত বাঁধ দিয়ে ভাঙন ঠেকানোর দাবি জানাচ্ছি।

স্থানীয় সমাজসেবক হামিদুর রহমান বলেন, চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫০ ফিট দূরেই নদীটি চলে এসেছে। দ্রুত ভাঙন ঠেকানো না গেলে স্কুলটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। আমাদের এখানে বেশিরভাগ লোক দরিদ্র কৃষক, একেতো আবাদি জমি হারিয়ে তারা নিঃস্ব হয়ে গেছে। আবার যদি স্কুলটিও নদীতে চলে যায় তাহলে তাদের ছেলেমেয়েদের দূরের কোনো প্রতিষ্ঠানে পড়াতে পারব না। যার ফলে বেশিরভাগ শিশু শিক্ষা হতে বঞ্চিত হয়ে পড়বে।

কথা হয় চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি শফিউল আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, এটা একটা গরীব এলাকা। এখানে একটাই স্কুল। এ স্কুলটা নদী যদি নিয়ে যায়, তাহলে শিক্ষাগ্রহণের আর উপায় থাকবে না। ব্যবস্থা না নিলে নতুন করে জমি দিয়েও স্কুল দেওয়ার মতো ব্যবস্থা নাই।

স্থানীয় ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম জানান, এ বছর মন্ডল মেম্বারের বাড়ি থেকে বাজারে আসার এক কিলোমিটার কাঁচা সড়ক নদীতে চলে গেছে। সঙ্গে ১০-১২ টি বাড়িও ভেঙে গেছে। এখন বাজার, স্কুল, শহীদ মিনার, মসজিদ ও মাদ্রাসাটা রক্ষা করতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে ভাঙন ঠেকাতে পদক্ষেপ নিতে হবে।

কামারের চর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, দশানি নদীর ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে ৭নং চরের বাজার, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শহীদ মিনার, মসজিদ ও মাদ্রাসা। পাশাপাশি অনেক আবাদি জমি নদীতে চলে গেছে। সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যেই এ ভাঙন ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের শেরপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী ইমদাদুল হক বলেন, ভাঙন এলাকার সার্বিক পরিস্থিতির ব্যাপারে আমরা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে অবগত করেছি। ২০০ মিটার কাজের নির্দেশনা আমরা পেয়েছি। ভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাজের টেন্ডারের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।

উবায়দুল হক/এএএ