নির্বাচন আসলেই প্রার্থীরা খোঁজ নেন তাদের
হবিগঞ্জের রাজনগর এলাকার রবিদাস পাড়া
হবিগঞ্জ-৩ (সদর-লাখাই-শায়েস্তাগঞ্জ) আসনের হিন্দুপ্রধান এলাকা যশেরআব্দা, নোয়াহাটি, বাতিরপু ও ঘাটিয়া। জেলা সদরের এই এলাকাগুলোতে ৯৯ ভাগ অধিবাসী হিন্দু। আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে তাদের মধ্যে আলাদা কোনো উত্তাপ-উত্তেজনা নেই। আপাত দৃষ্টিতে কোনো আতঙ্ক বা শঙ্কা তাদের মধ্যে নেই। স্বাভাবিক তাদের জীবন-যাপন। জাতীয় নির্বাচন বা স্থানীয় নির্বাচন কোনো নির্বাচনেই এই এলাকাগুলোতে কোনো ঝামেলা হয়নি।
কিন্তু বাইরে থেকে দেখা এই জীবন-যাপনের আড়ালের চিত্রটা ভিন্ন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বিশ্বনাথ (ছদ্মনাম) প্রতিদিন ছেলেদের সাবধান করেন যেন আড্ডা-গল্পে কোথাও নির্বাচন নিয়ে কথা না বলে। তার মতো মহল্লার অন্য বাসিন্দারাও রাজনীতির মতো বিষয় থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখেন। নির্বাচন ঘনিয়ে আসলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও কাজ করে তাদের মধ্যে। কখনো বড় ধরনের কোনো ঝামেলা না হলেও নির্বাচন ঘিরে কেন তাদের এই উদ্বেগ?
বিজ্ঞাপন
বিশ্বনাথসহ অন্যদের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপে উঠে আসে নির্বাচনকেন্দ্রিক তাদের অসহায়ত্বের কথা। প্রায় সব স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থীদের লক্ষ্য থাকে এই এলাকাগুলোর ওপর। এক দল মনে করে এদের ভোট বাঁধা। অন্য দল মনে করে এরা কখনো তাদের ভোট দেয় না। ফলে উভয় দলের হুমকির মধ্যে থাকতে হয় তাদেরকে। যে দলের প্রার্থী নির্বাচনে পরাজিত হয়, সহজ টার্গেট হিসেবে এই পাড়াগুলো লক্ষ্য হয়। বড় সহিংসতা ঘটেনি বটে, কিন্তু নির্বাচনের আগে কিংবা পরে হুমকি-ধমকি গালিগালাজের ঘটনা নিয়মিতই ঘটে। যেন এই ভোটরদের ওপরই নির্বাচনের জয়-পরাজয় নির্ভর করে।
নিজেরা বড় সহিংসতার শিকার না হলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, সুনামগঞ্জের শাল্লা, হবিগঞ্জের সীমান্তবর্তী এলাকার সহিংসতার ঘটনার পর হবিগঞ্জের মাধবপুর ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলাসহ প্রায় সমগ্র জেলার সংখ্যালঘুদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষত নাসিরনগরের ঘটনার পর মাধবপুর উপজেলা সদরের হিন্দুরা প্রায় সপ্তাহখানেক বাড়ি থেকে বের হননি। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলেননি। অথচ উপজেলা সদরের বেশিরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের।
বিজ্ঞাপন
তাদেরই একজন রঞ্জিত বণিক জানান, নাসিরনগরের ঘটনার পর থেকেই তারা আশঙ্কা করছিলেন মাধবপুরেও কিছু হতে পারে। সাম্প্রদায়িক উসকানিদাতাদের মিছিল, মিটিং, সমাবেশ সহিংস রূপ ধারণ করছিল। প্রশাসনকে বারবার জানানোর পরও তারা বিষয়টিকে তেমন আমলে নেয়নি।
দলিত সম্প্রদায়ের লোকজন বলছে, যে কোনো নির্বাচনে দাবার গুটির মতো ব্যবহার করা হয় সংখ্যালঘু দলিতদের। রবিদাস ও হরিজন সম্প্রদায় এর মধ্যে প্রধান। যেকোনো এলাকায় দলিত হিসেবে একত্রে বসবাস করেন তারা। ভদ্র সমাজের সঙ্গে এদের সত্যিকার অর্থে কোনো সামাজিক সম্পর্ক নেই। হবিগঞ্জের এমন দুটি পাড়ার মধ্যে রয়েছে শায়েস্তানগর রবিদাস পাড়া ও রাজনগরের হরিজন সম্প্রদায়ের পাড়া। দুটি পাড়ায় ভোটার পাঁচ শতাধিক। স্থানীয় কিংবা জাতীয় যেকোনো নির্বাচন আসলেই প্রার্থীরা ঘনঘন তাদের পাড়ায় যান। তাদের সঙ্গে সমস্ত সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন। কিন্তু নির্বাচনের পর তাদের দেখা পাওয়া যায় না। তাদের কোনো সমস্যারও সমাধান হয় না। কোনো গুরুতর প্রয়োজনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে তারা সাক্ষাৎ পর্যন্ত করতে পারেন না। অথচ নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী প্রায় নিয়ম করে এসে পাড়ায় ঢুকে গালিগালাজ করে হুমকি দেন।
রাজনগর হরিজন পাড়ার শ্রী মাধব হরিজন আক্ষেপের সুরে বলেন, নির্বাচনের সময় প্রায় সব প্রার্থী আমাদেরকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চান। কিন্তু আমরা বিনয়ের সঙ্গে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি। কারণ যদি তারা পরাজিত হন তাহলে ঠিকই এই টাকার জন্য আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন।
চা বাগান সংলগ্ন গ্রাম জগদিশপুর, বেজুড়া, সাতবর্গ প্রভৃতি গ্রামে অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। প্রায় প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের পর সাময়িক গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হন তারা।
তাদেরই একজন শিবন দত্ত চৌধুরী জানান, তার বাবা এলাকার একজন প্রভাবশালী হিন্দু। তিনি কখনো সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীর উত্তেজিত সমর্থকরা তাদের বাড়িতে ঢুকে শতবর্ষী ফলদ-বনজ গাছ কেটে নিয়ে যায়। তাদের বাড়ির কামলা-মুনীষদের রাস্তায় মারধর করে। বড় অংকের চাঁদা চেয়ে উড়ো চিঠি দেয়। ফলে তারা মান-সম্মান রক্ষার স্বার্থে এক কাপড়ে গ্রাম ছেড়ে হবিগঞ্জ শহরে মামার বাড়িতে চলে আসেন।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন ও বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রেমা-কালেঙ্গা চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত। এখানে ত্রিপুরা আদিবাসীদের কয়েকটি পাড়া রয়েছে। এছাড়াও সাঁওতাল, তেলেগু, উড়ং সম্পদ্রায়ের কিছু মানুষও বাস করেন এই বনের মধ্যে। সব মিলিয়ে এদের সংখ্যা হাজারখানেক। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একমাত্র ভোটের সময় এরা সভ্য সমাজের মানুষের দেখা পান। কিন্তু পরে পরিস্থিতি আগের মতোই।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ হবিগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট পূণ্যব্রত চৌধুরী বিভু জানান, আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শঙ্কায় তারা উদ্বিগ্ন। তবে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর ভরসা করতে চান।
কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার রুমা মোদক বলেন, হবিগঞ্জ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এলাকা। এখানে স্মরণকালে কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ঘটেনি। কিন্তু পার্শ্ববর্তী জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সুনামগঞ্জে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা এই জেলার সংখ্যালঘুদের ওপর প্রভাব ফেলেছে। সরাসরি হামলার শিকার না হলেও যেকোনো সাম্প্রদায়িক হামলা সংখ্যালঘুদের মনে সুদূরপ্রসারী ট্রমা তৈরি করে, তা থেকে মুক্তি পেতে সংখ্যালঘুরা দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে এই ট্রমা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এজন্য যে কোনো নির্বাচন সংখ্যালঘুদের কাছে আতঙ্কের বিষয়।
আরএআর