দুমুঠো খাবারের জন্য সন্তানকে দিয়ে দেন রোজিনা
মা রোজিনা আক্তার
দু-মুঠো খাবারের জন্য পেটের সন্তান প্রতিবেশীর কাছে দিয়ে দেন রোজিনা আক্তার। তিন মাসের গর্ভবতী থাকা অবস্থায় স্বামী মারা যাওয়ায় অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাতে হতো তাকে। খাদ্যভাবে পেটের সন্তান মারা যেতে পারে তাই প্রতিবেশী এক নিঃসন্তান নারীর কাছ থেকে খাবার নেন জন্মের পর সন্তানকে দিয়ে দেওয়ার শর্তে।
সম্প্রতি শরীয়তপুরের ডোমসার ইউনিয়নের মুন্সীরহাট বেদে পল্লিতে গিয়ে দেখা মিলেছে রোজিনা আক্তার নামে হতভাগা এই মায়ের। রোজিনা এক যুগেরও বেশি সময় আগে স্বামী শিপন মন্ডল ও একমাত্র ছেলে আতিককে নিয়ে ওই পল্লিতে বসবাস শুরু করেন।
বিজ্ঞাপন
জানা যায়, স্বামী শিপন মন্ডলের আয়ে ছেলেকে নিয়ে ভালোই কাটছিল তাদের জীবন। ২০২১ সালে রোজিনা তিন মাসের গর্ভবতী থাকা অবস্থায় মারা যায় স্বামী শিপন মন্ডল। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পরেন তিনি। পেটের সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর দিয়ে দেওয়ার শর্তে প্রতিবেশী পলি আক্তারের থেকে খাবারের নিশ্চয়তা পায় রোজিনা। জন্মের পর কথা মতো নিজের কন্যা শিশুটিকে পলি আক্তারকে দিয়ে দেন রোজিনা। অর্থের অভাবে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে এগারো বছর বয়সী একমাত্র ছেলে আতিকের। তিনবেলা খাবার জোগাড় করাই এখন রোজিনার জন্য পাহাড়সম কষ্টসাধ্য কাজ। ওই পল্লিতে ৪ শতাংশ জমি রয়েছে রোজিনার। ঘর না থাকায় কোনো রকমের একটি ছাপরা ঘরে বসবাস করছেন রোজিনা ও আতিক। আড়াই বছর আগে স্বামী মারা গেলেও বিধবা কিংবা বয়স্ক ভাতা না পাওয়ার আক্ষেপ রয়েছে রোজিনার। পেটের তাগিদে লেখাপড়া বন্ধ করে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামিয়েছেন এগারো বছর বয়সী ছেলে আতিককে। ভিক্ষার উপার্জন দিয়ে দুই তিন দিন পর পর একদিন চুলোয় হাঁড়ি জ্বলে রোজিনার।
রোজিনার প্রতিবেশী ঠান্ডু সরদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেদে পল্লিতে যারা থাকেন, তাদের সবারই নুন আনতে পান্তা ফুরায়। কে করবে তাকে সাহায্য, তারপরও কেউ কেউ ১০ টাকা বা এক আধসের চাল-ডাল দিলে রোজিনার চুলোয় আগুন জ্বলে। আমরা গ্রামে ঘুরি, এমন কষ্ট এখনও মানুষ করে তা কোথাও দেখিনি।
বিজ্ঞাপন
চান বানু বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেড় বছর আগে রোজিনার পেটে জন্ম নেওয়া কন্যা শিশুটি বেড়ে উঠছে নিঃসন্তান পলি আক্তারের কোলে। পেটের তাগিদে রোজিনা নিজ সন্তানকে পলি আক্তারকে দিয়ে দিয়েছেন। কোনো মা কি তার সন্তানকে দিতে চায়, পেটের দায়ে রোজিনা তার সন্তানকে দিয়েছেন।
রোজিনার ছেলে আতিক ঢাকা পোস্টকে বলে, বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে স্কুলে যাই না আর। মা ও নিজের খাবার যোগাতে এখন ভিক্ষা করি। বয়সে ছোট হওয়ায় আমাকে কেউ কাজে নেয় না। বাধ্য হয়েই ভিক্ষা করি। তারপরও না খেয়ে থাকতে হয়।
রোজিনা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার মতো হতভাগা আর কেউ নেই পৃথিবীতে। বিধবা ভাতা অফিস, বয়স্ক ভাতা অফিস কত জায়গায় গেছি, কেউ আমাকে সাহায্য করেনি। গর্ভবতী অবস্থায় খাবার পাওয়ার শর্তে পেটের সন্তান পলিকে দিয়ে দিয়েছি। নিজে রেখেই বা কী করব! বড় ছেলেকে তো মানুষ করতে পারলাম না। ছেলেকে দিয়ে ভিক্ষা করাই, তারপরও খাবার জুটে না। মেয়েকে রাখলে তো তাকে দিয়েও ভিক্ষা করাতে হতো। সরকার কত মানুষকে ভাতা দেয়, ঘর দেয়, খাবার দেয়, কত কিছু দেয়। কিন্তু আমি এসবের কিছুই পেলাম না।
পলি আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, কতটা অসহায় হলে পেটের সন্তানকে অন্যকে দিয়ে দেয় মা তা রোজিনাকে না দেখলে বুঝা যায় না। আমিও গরীব মানুষ। বাচ্চা পেটে থাকা অবস্থায় তিনি আমাকে খাবার দিতে বলেন। খাবার দিলে আমাকে বাচ্চাটা দিয়ে দিবে বললে আমি খাবার দেই। বাচ্চাটাকে আদর যত্নে লালন পালন করছি আমি।
শরীয়তপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র ঢাকা পোস্টকে বলেন, রোজিনার বিষয়টি জানতে পেরে সরেজমিনে গিয়ে দেখেছি। তাকে ২০ দিনের খাবার দেওয়া হয়েছে। আগামীকাল জেলা প্রশাসক মহোদয় ওই পল্লিতে যাবেন। রোজিনার পরিবারকে সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করে দেবে প্রশাসন।
সাইফুল ইসলাম সাইফ রুদাদ/এএএ