চিকিৎসার অভাবে হামিদুলের শিকলবন্দি জীবন
নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার পশ্চিম মাধনগর এলাকার বামনপাড়া গ্রামের বাসিন্দা হামিদুল (১৯)। ছোটবেলায় খুব চঞ্চল প্রকৃতির থাকায় বাড়িতে আটকে রাখার সাধ্য ছিল না কারও। হামিদুলের বয়স যখন ৯, তখন কাউকে না জানিয়ে স্থানীয় নির্বাচনের প্রচারণায় যায় সে। সেখানে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয় হামিদুল। টাকার অভাবে সেসময় ভালো চিকিৎসা করাতে পারেনি পরিবার।
সাধ্য অনুযায়ী চিকিৎসায় তখন মোটামুটি সুস্থ হলেও হামিদুলের মাথার আঘাতের তীব্রতা কাল হয়ে দাঁড়ায়। ওই দুর্ঘটনার জেরেই চার বছর পর হামিদুল মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। এরপর থেকেই অস্বাভাবিক আচরণ ও বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করতে নিরুপায় হয়ে হামিদুলের বাবা-মা তার পায়ে শিকল বেঁধে দেয়। যা দীর্ঘ ৫ বছরেও খোলা হয়নি। হামিদুলের সারা দিনের সঙ্গী ওই একখানা শিকল।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে উপজেলার চক সরভৈতা মন্ডলপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নানার বাড়িতে একটি আম গাছের সঙ্গে শিকলবন্দি হামিদুল। শিকলের এক প্রান্ত পায়ের নিচ অংশে আটকানো আর আরেক প্রান্ত আম গাছের সঙ্গে পেঁচানো। সেখানে ভেজা মাটিতেই বসে আসে হামিদুল। সেখানেই খাওয়া-দাওয়া, প্রসাব-পায়খানা। হামিদুলকে এভাবে দেখতেই অভ্যস্ত নানার বাড়ি এলাকার মানুষ।
কিন্তু ছোটবেলার সেই দুরন্ত হামিদুলকে শিকলবন্দি করে রাখতে বুক ফেটে যায় মা হাজরা বেগমের। বাবা জহুরুল ইসলামেরও চাপা কষ্ট অজান্তেই প্রকাশ পেয়ে যায়। প্রতিবেদকের অনুরোধে খানিকটা সময় পায়ের শিকল খুলে দেওয়া হলে দেখা যায় হামিদুলের ভয়ংকর রূপ। কখনো হাতে বাঁশ নিয়ে, কখনো দৌড়ে আঘাত করতে প্রতিবেশীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে হামিদুল। এ দেখে ভয়ে সবাই পালাতে থাকে। পরে আবারও তাকে শিকলবন্দি করা হয়।
বিজ্ঞাপন
হামিদুলের পরিবার সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নলডাঙ্গা উপজেলার ব্রহ্মপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ২নং ওয়ার্ডের সদস্য প্রার্থী হয়েছিলেন একই এলাকার মো. উজ্জল হোসেন। সকলের অগোচরে শিশু হামিদুল তার নির্বাচনী প্রচারণায় গেলে সেখানে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়। এ সময় মাথায় মারাত্মক আঘাত পায় সে। পরে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসার মাধ্যমে কাটাছেঁড়া ভালো হলেও মাথার ব্যথা ভালো হয়নি। যে কারণে চার বছর পরে মানসিক রোগীতে পরিণত হয় সে। হামিদুলের আচরণও অস্বাভাবিক আকারে রূপ নেয়। যাকে তাকে মারধর, ভাঙচুর করতে থাকে। পরে বড় ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে বাধ্য হয়ে হামিদুলকে শিকলবন্দি করে পরিবার।
হামিদুলের বাবা জহুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৪ সালে প্রতিবেশী উজ্জ্বলের নির্বাচনী প্রচারণায় গিয়ে আমার ছেলের এক্সিডেন্ট হয়। প্রথমে এলাকাতেই চিকিৎসা করে শরীরের ক্ষত ভালো হয়। কিন্তু মাথার যন্ত্রণা ভালো হয় না। এটা নিয়ে আমার সাধ্য অনুযায়ী পাবনা মানসিক হাসপাতাল থেকে শুরু করে অনেক জায়গায় গেছি। কিন্তু কাজ হয় না। পরে ধীরে ধীরে হামিদুলের আচার আচরণ আরও পরিবর্তন চলে আসে। আজ একে মারতে যায়- কাল ওকে মারতে যায়। বাড়ির জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। পরে বাধ্য হয়ে ২০১৮ সালে হামিদুলকে শিকলবন্দি করি।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত হামিদুলের চিকিৎসার পেছনে ২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা খরচ করে ফেলেছি। এখন বাড়ির ভিটা ছাড়া কিছুই নেই। ঠিক মতো খাবারও জোগাতে পারি না। ছেলেটাকে এভাবে দেখে খুব কষ্ট হয়। টাকা-পয়সার অভাবে চিকিৎসাটাও ঠিক মতো করাতে পারিনি। জানি না ভবিষ্যতে কী হবে।
হামিদুলের মা হাজরা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ছেলেটা ছোটবেলায় খুব চঞ্চল প্রকৃতির ছিল। সারাক্ষণ দৌড় ঝাঁপ করতো। ভোটের সময় এক্সিডেন্ট হয়ে ছেলেটার আজ এই অবস্থা। সেসময় অনেকেই হামিদুলের পাশে থাকার কথা বলেছে। কিন্তু পরে কেউ পাশে থাকেনি। একবার দেখতেও কেউ আসেনি।
তিনি বলেন, এখন শিকলে বেঁধে রেখেই খাবার দেই। একদিন খেলে দুইদিন চলে যায় তবুও খাবার খায় না। আবার অনেক সময় খাবার দিলে ফেলে দেয়। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে চলে যাচ্ছে। প্রস্রাব-পায়খানা এলে চিৎকার শুরু করে পরে পলিথিন দিলে সেখানে পায়খানা করে, আমরা সেগুলো পরিষ্কার করে দেই।
প্রতিবেশীর বলেন, এখনকার চিকিৎসাসেবা অনেক উন্নত। যদি সঠিক চিকিৎসা করা যায় তাহলে হয়তো হামিদুল সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু হামিদুলের উন্নত চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্য পরিবারের নেই। তার চিকিৎসায় বিত্তবান ও সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান এলাকাবাসী।
এ বিষয়ে নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেওয়ান আকরামুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, হামিদুলের ঘটনাটি ইতিমধ্যেই অবগত হয়েছি। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি তার সুবর্ণ কার্ড (প্রতিবন্ধী কার্ড) রয়েছে, কিন্তু সে ভাতা পায় না। পরে সমাজসেবা অফিসারের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত ভাতা পাওয়ার আবেদন করে দিয়েছি। সামনে থেকে অবশ্যই সে ভাতা পাবে। সেই সঙ্গে হামিদুলের উন্নত চিকিৎসা জন্য উপজেলা পরিষদ থেকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি।
আরএআর