শারীরিক প্রতিবন্ধী মেয়ে ফাতিমার সঙ্গে মা আলেয়া বেগম

‘সুযোগ পাইলে এট্টু লেহাপড়া হিকতাম (শিখতাম)। মাইয়া পোলাগো হিকাইতাম। মোরাতো গাঙ্গে ভাসমান। না আছে বাড়িঘর, না আছে মরার পর কয়বোর (কবর) দেওনের জায়গা। স্বামী মরার পর গাঙ্গের ওপার এক বেডার হাতে-পায়ে ধইরা কয়বোর দিছি।’

আফসোস করে কথাগুলো বলছিলেন আলেয়া বেগম। ষাটোর্ধ্ব এই নারী মান্তা সম্প্রদায়ের। মান্তা যাযাবর বেদে জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত। মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বরিশাল সদর উপজেলার লাহারহাট লঞ্চঘাট সংলগ্ন তেতুলিয়া শাখা নদীতে অবস্থান করা নৌ-বহরে কথা হয় তার সঙ্গে।

আলেয়া বেগমের দুই মেয়ে। ছোট মেয়ে কুলসুমের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় স্বামীর নাওয়ে ভাসানচর বহরে থাকেন। বড় মেয়ে কুলসুমকে নিয়ে লাহারহাটের বহরে থাকেন তিনি। বড় মেয়ের বয়স ত্রিশ পার করেছে। এই ত্রিশ বছরই কেটেছে তার ছোট্ট নৌকায়।

আলেয়া বলেন, ‘হাউস কইররা নামতো রাখছিলাম ফাতিমা। কিন্তু মাইয়াডা কোনোদিন নাওয়ের বাইরে বেড়াইতে পারে নাই। ও হাটতে-চলতে পারে না, কথা কইতে পারে না। উইট্ঠা খাড়াইতেও (দাঁড়াতে) পারে না। মাইয়াডা মোর আজাবে আজাবে জীবন পার করলো।’

মান্তা সম্প্রদায়ের লোকজন এভাবেই ভাসমান জীবন-যাপন করেন।

শারীরিক নানান প্রতিবন্ধীত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন ফাতিমা। ভোটার হওয়ার সুযোগ পাওয়ার পর টুঙ্গীবাড়িয়া ইউনিয়নের অসংখ্যবার গিয়েছিলেন একটু সাহায্যের জন্য। কিন্তু আজও কোনো সহায়তা পাননি।

তিনি বলেন, ‌‘কতদিন যাইয়া খাড়াইয়া আছিলাম চেয়ারম্যানের লগে দেহা করার জন্যি। মোরাতো বাইদ্যা, পরিষদের মইদ্যেই ঢুকতে পারি নাই। এহন আর যাই না। এহন নিজের যা রোজগার করতে পারি হেইয়া দিয়াই পেট চলে। আইজ বেন বেলা (সকাল) জাল টাইন্যা যে মাছ পাইছি ৭০ টাহায় বেইচ্চা (বিক্রি) আইছি। এই দিয়া দিন চলবে।’

আলেয়া বেগম জানান, তার মেয়ে ফাতিমা জন্মের পর থেকে কোনো মানুষের সামনে যেতে পারেনি। নৌকায় শুয়ে থেকে শুধু বাইরে তাকিয়ে থাকে। মা ঘরে ফিরে পোশাক পরিয়ে খাবার খাওয়ান, যত্ন নেন। অন্য সময় খালি গায়েই থাকেন অধিকাংশ সময়।

প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার জন্য নৌকার একপ্রান্তে নিয়ে এলে ভয়ে বারবার চিৎকার করছিল ফাতিমা। মা আলেয়া বেগম সংবরণ করছিল। কিন্তু মায়ের কথায় আস্থা পাচ্ছিলেন না ফাতিমা। চিৎকার করেই যাচ্ছিলেন।

আলেয়া বেগম

আলেয়া বেগম জানান, মাছ বেচে যে টাকা পান সেটাও হিসেব করতে জানেন না তিনি। পড়াশোনা জানা কারো কাছ থেকে টাকা হিসেব করে নেন। তার পূর্বপুরুষেরাও এই নৌকায় জীবন পার করেছে। সরকার তাদের জন্য ব্যবস্থা করলে তারা হয়ত একটা ঠাঁই পেতো। প্রতিবন্ধী সেই মেয়ের ভাতার ব্যবস্থা করা হলে হয়ত তার কষ্ট কিছুটা লাঘব হতো। 

বহরের সরদার জসিম উদ্দিন বলেন, আলেয়া বেগম তার প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে খুব অসহায় অবস্থায় আছেন। তিনি বিভিন্নজনের কাছে সহায়তা চাইলে তেমন সহায়তা পাননি। বেদে গোষ্ঠীর নিয়ম অনুযায়ী আমরা যতটুকু পারি সহায়তা করি। তবে সরকারি সহায়তা হলে ভালো হয়।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের জেলা প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, বিষয়টি আপনার মাধ্যমে জানতে পারলাম। খোঁজ-খবর নিয়ে দেখছি। প্রতিবন্ধী ফাতিমা ও তার মাকে সহায়তা করা হবে বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/এএএ