পায়ের ক্ষত নিয়েই ২০ দিন যাবৎ হাসপাতালে বৃদ্ধ, দেখার কেউ নেই
বৃদ্ধ আব্দুল মোমেন
ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ আব্দুল মোমিন মণ্ডল। বছর দুয়েক আগে ঢালাই কাজ করতে গিয়ে তার বাম পায়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। শুরুতে ক্ষতস্থানকে তেমন গুরুত্ব দেননি তিনি। কিছুদিন পর শুরু হয় জ্বালাপোড়া। পরে চিকিৎসাও নেন। কিন্তু পা ভালো হয়নি। এরপর পায়ে পচন ধরলে আসেন চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে। গত ২০ দিন যাবৎ এই হাসপাতালের মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। পরিবার-পরিজন থাকলেও দেখার কেউ নেই গ্যাংগ্রিন (পচনশীল ক্ষত) রোগে আক্রান্ত বৃদ্ধ মোমিনের। উন্নত চিকিৎসার জন্য সদর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অর্থ এবং আত্মীয়স্বজন কেউ না থাকায় হাসপাতালের মেঝেতেই ধুঁকছেন পা নিয়ে।
আব্দুল মোমিন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার আলুকদিয়া ইউনিয়নের চকপাড়ার মৃত আবুল মণ্ডলের ছেলে।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, আব্দুল মোমিন মণ্ডল পেশায় ছিলেন রাজমিস্ত্রী। স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে ভালোই চলছিল তার সংসার। সাত বছর আগে বিচ্ছেদ ঘটে স্ত্রীর সঙ্গে। এরপর থেকে ছোট দুই ছেলে মায়ের সঙ্গেই থাকে। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় মেয়ে হাসি খাতুন মাঝেমধ্যে বাবার খোঁজ নিলেও আর কেউ খোঁজ নিতে আসে না বৃদ্ধ পিতার। হাসপাতালের রোগীদের জন্য বরাদ্দকৃত খাবার আর সরকারি সামান্য ওষুধই তার বেঁচে থাকার সম্বল।
সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত আগস্ট মাসের ৩১ তারিখে আব্দুল মোমিন মণ্ডলকে হাসপাতালে ভর্তি করেন তার বড় মেয়ে হাসি খাতুন। ভর্তির দু-দিন পরেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করে। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দিলেও অর্থ ও স্বজনদের কেউ পাশে না থাকায় পচনশীল পা নিয়েই হাসপাতালের মেঝেতে অসহায়ত্ব জীবনযাপন করছেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
গতকাল মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) রাতে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সদর হাসপাতালে পুরোনো ভবনের নিচতলার সিঁড়ির সামনে কম্বল গায়ে বসে আছেন আব্দুল মোমিন মণ্ডল। পচনশীল স্থানে একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছেন। আশপাশে কোনো রোগী নেই। প্রতিবেদককে দেখেই কিছু খাবার চাইলে প্রতিবেদক খাবারের ব্যবস্থা করে দেন।
খাবার খেতে খেতেই আলাপচারিতায় বৃদ্ধ মোমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় বছর দুয়েক আগে আলুকদিয়া ইউনিয়নের ঝোড়াঘাটা গ্রামে এক বাড়িতে রাজমিস্ত্রীর (ঢালাই) কাজ করার সময় ভাঙ্গা ইটে বাম পায়ের তালু কেটে যায়। বিষয়টি আমি শুরুতে গুরুত্ব দেইনি। কয়েকদিন কাজ করার পর হঠাৎ জ্বালাপোড়া শুরু হয়। পরে সদর হাসপাতালসহ স্থানীয় চিকিৎসকের দেওয়া ওষুধ খেয়েছি। কোনো ওষুধেই কাজ হয়নি। ধীরে ধীরে পায়ের পাতায় পচন ধরতে শুরু করে। আমার জ্বালাপোড়া দেখে ১৯ দিন আগে বড় মেয়ে সদর হাসপাতাল ভর্তি করে। ডাক্তার বলেছে এখানে চিকিৎসা হবে না, রাজশাহী যেতে হবে।
এরপর দীর্ঘক্ষণ চুপ থেকে আব্দুল মোমিন মণ্ডল বলেন, হাসপাতালে দ্বিতীয় তলার সার্জারি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছিলাম। পায়ের ক্ষত থেকে দুর্গন্ধ বের হওয়ায় কয়েকদিন আগে হাসপাতালের লোকজন আমাকে নিচতলায় সিঁড়ির এখানে রেখে গেছে। এরপর থেকে এখানেই আছি। হাসপাতাল থেকে যা খাবার দেয়, কোনোরকম খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। সরকারি ওষুধ দু-একটা দেয়, তাই খাই। ডাক্তার আমাকে রাজশাহী যেতে বলেছে। অপারেশন করা লাগবে। একদিকে টাকার অভাব, অন্যদিকে একা একা কীভাবে যাবো রাজশাহী। আমি তো হাঁটতেই পারি না। নিয়ে যাবেই বা কে। স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়ার পর দুই ছেলেকে নিয়ে চলে গেছে। তারা খোঁজ নেয় না। আর দুইটা মেয়ে আছে তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। তারাও নিজ নিজ সংসারে থাকে। বড় মেয়েটা দু-দিন পর একবার দেখতে আসে। এখন আমি কী করব, বুঝতে পারছি না।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে অর্থোপেডিক কনসালটেন্ট ডা. মিলনুরজামান জোয়ার্দ্দার ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোমিন গ্যাংগ্রিন রোগে আক্রান্ত। কোনো আঘাত বা সংক্রমণের ফলে অথবা রক্ত সঞ্চালনের কোনো দীর্ঘস্থায়ী সমস্যায় ভোগার ফলে যে কারো এ রোগ হতে পারে। পচনশীল ক্ষতের প্রাথমিক কারণ দেহকলাতে রক্তসঞ্চালন কমে যাওয়া, যার ফলে কোষের মৃত্যু হয়। সদর হাসপাতালে এ রোগের চিকিৎসা হয় না এবং আমি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞও না। যে কারণে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেছি। বৃদ্ধ আব্দুল মোমিন হাসপাতালের মেঝেতেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আমরা যতটা পারছি তাকে চিকিৎসা ও হাসপাতাল থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করছি। এভাবে বেশিদিন থাকলে তার অবস্থার আরও অবনতি হতে পারে।
আফজালুল হক/এএএ