‘মনে হয় কামের আকাল পড়ছে’
আকাশে কালো মেঘ। পড়ছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। ঘড়ির কাটায় তখন সকাল ৭টা। সড়কে মানুষের উপস্থিতি কম। এমন সাতসকালে জটলা বেঁধে বসে আছে কিছু লোকজন। পেশায় তারা দিনমজুর, শ্রম বিক্রি করেন। কাজের সন্ধানে প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে বাইসাইকেলের বহর নিয়ে বের হন। এসব মানুষ নিজেকে ‘কামলা’ হিসেবে পরিচয় দেন।
শ্রম বিক্রির সুযোগ পেলে হাসি মুখে ছুটে যান ঘণ্টা চুক্তির কাজে। তবে তারা সবাই প্রতিদিন শ্রম বিক্রি করতে পারেন, এমনটা নয়। তাদের মধ্যে কিছু মানুষ কাজ পায়, আর কিছু মানুষ কাজ না পেয়ে ফেরতও যায়। সেই কথাই জানালেন পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী দিনমজুর রফিকুল ইসলাম।
বিজ্ঞাপন
টানা তিন দিন ধরে শ্রম বিক্রির হাটে কাজ না পেয়ে কপালে চিন্তার ভাজ নিয়ে রফিকুল বলছিলেন, ঝড়-বৃষ্টির দিনোত মাইনসে হামাক কাজোত নেবার চায়না। কিন্তু হামরা যদি কাম (কাজ) না পাই খামো কি? খুব কষ্টে ধার-দেনা করে সংসার চলোছে। আগের মতো মাইনসে হামাক আর কাজোত নেয় না। মনে হয় কামের আকাল পড়ছে।
শনিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) সকালে রংপুর নগরীর শাপলা চত্বর এলাকায় শ্রম বিক্রির হাটে দেখা হয় রফিকুলের সঙ্গে। তার মতো আরও অনেকেই ছিলেন সেখানে। কোদাল-কাস্তে, ভার-ডালি আর বাঙ্ককা নিয়ে দলবদ্ধভাবে বসে আছেন শ্রম বিক্রির আশায়। সেখানে বসে বসে তারা নিজেরা একে অপরের সঙ্গে গল্প করেন। তাদের গল্পে থাকে সংসারের ভালো-মন্দ নানা কথা। বেলা বাড়ার সঙ্গে তাদের কেউ যায় কাজে, আর কেউ ফিরে যায় শূন্য হাতে।
বিজ্ঞাপন
শাপলা চত্বর এলাকায় রাস্তার দুইপাশে প্রতিদিন শ্রমের উপকরণ নিয়ে অন্তত ১৫ থেকে ২০ জন মধ্যবয়সী শ্রমিক একসঙ্গে বসেন। তাদের একজন আশরাফুল ইসলাম। নগরীর ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের ভুড়ারঘাট ফতেপুর এলাকায় তার বাড়ি। সাতসকালে বাইসাইকেল চালিয়ে শহরে শ্রম বিক্রি করতে আসা আশরাফুল বলেন, ছয় সদস্যের পরিবার। এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেটা কলেজে পড়ছে, আর মেয়েটা স্কুলে। লেখাপড়া আর সংসারের খরচের যোগান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কয়েক মাস থেকে কাজের অবস্থা খারাপ। একদিন কাজ জুটলে ৩-৪ দিন হয় না। নিরূপায় হয়ে আমার ছেলেটাও মাঝে-মধ্যে আমার সঙ্গে কাজ করে।
একই অবস্থার কথা জানালেন রফিকুল-আশরাফুলের সাথে থাকা অন্য শ্রমিকেরা। আর এসব মানুষের নিত্যদিনের সুখ-দুঃখের গল্প-আড্ডার খোঁজ রাখেন স্থানীয় যুবক আহমেদ রানা। কখনো কখনো নিজে দাঁড়িয়ে থেকে শ্রম বিক্রিতে তাদের সহযোগিতাও করেন তিনি।
এই প্রতিবেদককে আহমেদ রানা বলেন, প্রতিদিন শাপলা চত্বর এলাকায় শ্রম বিক্রির হাটে বিভিন্ন পেশার দিনমজুর আসেন। এই পেশার মানুষগুলো দেশের প্রতিটা জেলায় রয়েছে। তারা মূলত সকালবেলায় আসেন কাজের সন্ধানে। তাদের মধ্যে কিছু মানুষ কাজ পায়, আবার কিছু মানুষ কাজ না পেয়ে ফেরত যায়। আমি তাদেরকে খুব কাছ থেকে দেখার ও জানার সুযোগ পেয়েছি। তাদের দুঃখ কষ্টের কথাগুলো শুনলে খুবই খারাপ লাগে। এই মানুষগুলো যখন কাজ না পেয়ে ফিরে যায়, তখন তাদের মনটা ভীষণ ভারি থাকে।
শুধু শাপলা চত্বর এলাকাতেই নয় নগরীর বেতপট্টি মোড়, গণেশপুর ক্লাব মোড়, বুড়িরহাট রোড, মডার্ন মোড়, পার্ক মোড়সহ বিভিন্ন এলাকায় শ্রম বিক্রি করতে আসা মানুষদের দলবদ্ধভাবে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বসে থাকতে দেখা যায়। তাদের মধ্যে কেউ মাটিকাটা ও ইটবহনকারী শ্রমিক, কেউ ইমারত শ্রমিক, কেউ আবার কৃষিশ্রমিক। তবে শ্রম বিক্রির প্রয়োজনে অনেকেই সব ধরণের কাজ করে থাকেন।
নগরীর সচেতন মহলের প্রতিনিধিরা বলছেন, এ সকল শ্রমজীবী মানুষের ক্ষুধা-দারিদ্র্য নিবারণে বিকল্প শ্রম-কর্মসংস্থান সৃষ্টি এখন সময়ের দাবি। অথচ আধুনিকায়নের যুগে শ্রমের পরিধি কমে আসছে। তবে এখনও বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। রংপুরে কলকারখানা নেই, শ্রমিকদের জন্য তেমন কাজের সুযোগ নেই। শ্রম ব্যবস্থা না থাকার কারণে দিন দিন শ্রমজীবী মানুষেরা বেকার হয়ে পড়ছেন। সেই সঙ্গে বাড়ছে বেকারত্ব।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন রংপুর মহানগর সভাপতি অধ্যক্ষ খন্দকার ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, আধুনিকায়নের যুগে ইটপাথরের দেয়ালের পরিমাণ যে হারে বাড়ছে, সেই হারে চাষাবাদের জমি বাড়ছে না। উল্টো দ্বিগুণ হারে কমে যাচ্ছে। এসব কৃষি জমিতে শ্রম দেওয়া শ্রমিকেরা তাদের কর্মের জায়গা দিন দিন হারিয়ে ফেলছে। যার ফলে রংপুর শহরে হরহামেশাই শ্রম বিক্রি করতে আসা শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
রংপুর মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক রাকিবুল হাসান বলেন, রংপুরে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কলকারখানা গড়ে তোলা জরুরি। অথচ সময়ের সঙ্গে রংপুর এগিয়ে গেলেও প্রত্যাশানুযায়ী এই জেলায় তেমন কলকারখানা নেই। কৃষিভিত্তিক কলকারখানা স্থাপন, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, ক্ষুদ্র-মাঝারি ও ভারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনাসহ শ্যামপুর সুগার মিলস চালু করা সম্ভব হলে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ হবে। শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও হাহাকার কমে আসবে। পাশাপাশি তারা স্থায়ী কর্মসংস্থান খুঁজে পাবে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরকে