নীলফামারীর সৈয়দপুরে পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন প্রকল্প নিয়ে নানা অভিযোগ উঠেছে। এসবের মধ্যে প্রকল্পের বরাদ্দকৃত বীজসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সময়মতো বিতরণ না করা, তদারকির অভাব এবং আর্থিক অনিয়ম অন্যতম। ফলে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার ভিত্তিক এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ভেস্তে গেছে। বর্তমানে সৈয়দপুরে স্থাপিত পারিবারিক পুষ্টি বাগানগুলোর বেশি ভাগই শাকসবজিবিহীন খালি অবস্থায় পড়ে রয়েছে। যদিও এগুলো সারা বছরই শাকসবজিতে ভরে থাকার কথা।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা রয়েছে দেশের কোথাও এক ইঞ্চি জমিও যেন অব্যবহৃত না থাকে। তার নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সারা দেশে অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন প্রকল্পটি গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলায় ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৭টি, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৫৬টি এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮৪টি বাগান স্থাপন করা হয়। এসব স্থাপনের আগে কৃষান-কৃষানিদের দুই দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এছাড়া প্রতিটি বাগান স্থাপনে বীজসহ প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৩ হাজার ৭০০ টাকা করে। ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে পারিবারিক পুষ্টি বাগান ব্যাপক সাড়া পড়ে। কৃষান-কৃষানিরা তাদের দৈনন্দিন পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ ছাড়াও উৎপাদিত শাকসবজি বাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছিলেন।

কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরে উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে তেমন নজরদারি করা হয়নি। এগুলো নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। বাগান প্রদর্শনী, রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনঃস্থাপনে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ে নির্দিষ্ট সময়সীমা পার হলেও তা করা হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এ উপজেলায় ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে বাস্তবায়িত ২৮৩টি পারিবারিক সবজি পুষ্টি বাগান প্রদর্শনী রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনঃস্থাপনের জন্য পাঁচ লাখ ৬৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রতিটি পারিবারিক পুষ্টি বাগান প্রদর্শনী রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনঃস্থাপনের জন্য বরাদ্দ রয়েছে দুই হাজার টাকা। এর মধ্যে সবজি বীজ ও গাছের চারার জন্য এক হাজার টাকা এবং বাগান মেরামত ও পুনঃস্থাপন (বেড়া ও সাইনবোর্ডসহ) বাবদ এক হাজার টাকা। দাপ্তরিক নির্দেশনায় বরাদ্দকৃত অর্থ ২০২৩ সালের ৩০ জুনের মধ্যে পিপিআর ২০০৮ ও বিদ্যমান সরকারি বিধি মোতাবেক খরচ করার কথা। এছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙিনায় ৮৪টি পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপনের জন্য ব্যয় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩ লাখ ১০ হাজার ৮০০ টাকা।

কিন্তু পারিবারিক পুষ্টি বাগান প্রদর্শনী রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনঃস্থাপনে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ে নির্দিষ্ট সময়সীমার অতিবাহিত হওয়ার দুই মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তা করা হয়নি। ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৭টি এবং ২০২১-২২ অর্থবছরের ২৫৬টিতে এখন নেই কোনো শাকসবজি। বর্তমানে এসব বাগান অযত্নে অবহেলায় পড়ে রয়েছে। অনেকগুলোর অস্তিত্বই নেই। এগুলোর বেড়া, সাইনবোর্ড ভেঙে পড়ে রয়েছে। আগাছা বা বিভিন্ন গাছগাছড়ায় পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে পারিবারিক পুষ্টি বাগানগুলো।

সম্প্রতি উপজেলার বাঙ্গালীপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে পুষ্টি বাগানগুলো বেহাল অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। এ ইউনিয়নের বালাপাড়ার গিয়ে দেখা যায় কৃষানি হাবিবা বেগমের পুষ্টি বাগানটি খালি পড়ে রয়েছে। শুধু বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। সেখানে নেই কোনো সাইনবোর্ড।

কৃষানি হাবিবা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এর আগে আমার পুষ্টি বাগান থেকে অনেক শাকসবজি পেয়েছি। আর সেসব নিজের পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবেশীদের দিয়ে বাজারেও বিক্রি করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কৃষি বিভাগ থেকে কোনো বীজ কিংবা উপকরণ দেওয়া হয়নি। শুধু বলেছে পুষ্টি বাগানের জমি তৈরি করে রাখতে। তাই কৃষি বিভাগের আশায় পুষ্টি বাগানের জমি চাষ করে অপেক্ষার প্রহর গুনছি।

একই ইউনিয়নের লক্ষণপুর এলাকায় ফেন্সি বেগমের পারিবারিক পুষ্টি বাগানে গিয়ে দেখা যায়, শুধু কয়েকটি বেগুন ও পেঁপে গাছ ছাড়া আর কোনো শাকসবজি নেই। ওই কৃষাণীর স্বামী রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে জানান, কৃষি বিভাগ থেকে বীজ ও নেট আনার জন্য বলেছিল। কিন্তু আমি উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার কাছে গিয়ে তাকে না পেয়ে ফিরে এসেছি।

উপজেলা কামারপুকুর ইউনিয়নের ধলাগাছ মুন্সিপাড়া কৃষানি ওয়াহিদা বেগমের পারিবারিক পুষ্টি বাগানটি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় সেখানেও কোনো শাকসবজি নেই। গত বছরের পহেলা জুন তার পারিবারিক পুষ্টি বাগানটি স্থাপন করা হয়েছে।

কৃষানি ওয়াহিদা বেগম ঢাকা পোস্টকে জানান, ওই সময় কিছু বীজ দিলেও এরপর আর কৃষি বিভাগ থেকে কোনোরকম খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। বর্তমানে তার পুষ্টি বাগানে কেবল দুইটি লেবু ও একটি পেঁপে গাছ রয়েছে।

এদিকে উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের শুধু ব্রহ্মোত্তর কৃষি ব্লকেই গত ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪১টি পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন করা হয়েছে। আর এ পুষ্টি বাগানগুলোর দিকে কৃষি বিভাগ থেকে সার্বক্ষণিক নজর রাখাসহ তদারকি করা হচ্ছে। কারণ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কিংবা পারিবারিক পুষ্টি বাগান প্রকল্পের কর্মকর্তারা রংপুর কৃষি অঞ্চল পরিদর্শনে এলেই তাদের সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুকুর ব্রহ্মোত্তর কৃষি ব্লকের এসব পুষ্টি বাগান দেখানো হচ্ছে।

কৃষি বিভাগের একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদক পুষ্টি বাগান নিয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলে বিষয়টি জানতে পেরে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ধীমান ভূষণ তৎপর হয়ে ওঠেন। তিনি তড়িঘড়ি করে কিছু শাকসবজির বীজ কিনেন। তৈরি করেন কিছু পারিবারিক পুষ্টি বাগান প্রদর্শনী পুনঃস্থাপন সাইনবোর্ড।

তবে পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপনে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে সৈয়দপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ধীমান ভূষণ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। গত আট মাসে আমার দায়িত্বকালে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌর এলাকায় নতুনভাবে ৬৩টি বাগান স্থাপন করা হয়েছে। আর পুনঃস্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বরাদ্দ দেরিতে পাওয়ায় বাগানগুলোর জন্য বীজ ও প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রদানে কিছুটা বিলম্ব ঘটেছে। 

এমজেইউ