মাঝরাত থেকে ইলিশ আহরণে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা, দুশ্চিন্তায় জেলেরা
সারা বছরের খরা কাটিয়ে রাজবাড়ীর পদ্মা নদীতে জেলেদের জালে অল্পস্বল্প ইলিশের দেখা মেলার সময়েই শুরু হলো মাছ আহরণ সংক্রান্ত সরকারি নিষেধাজ্ঞা। পদ্মার মা ইলিশ রক্ষার জন্য বুধবার রাত ১২টার দিকে শুরু হওয়া এই নিষেধাজ্ঞা চলবে আগামী ২ নভেম্বর পর্যন্ত।
কিন্তু রাজবাড়ির জেলেদের এখন প্রধান দুশ্চিন্তা— ২২ দিনের এই নিষেধাজ্ঞার দিনগুলোতে তারা সংসার চালাবেন কীভাবে।
বিজ্ঞাপন
রাজবাড়ী জেলার চারটি উপজেলাই পদ্মা নদীর তীরবর্তী। এসব উপজেলার অধিকাংশ মানুষই মৎসজীবী। আগামী ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ইলিশ আহরণ, পরিবহণ, মজুদ, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ থাকবে।
জেলায় কার্ডধারী মৎসজীবীর সংখ্যা ১৪ হাজার ৯৩ জন থাকলেও নিষেধাজ্ঞার সময়ে ৪ হাজার ৬৯৩ জনকে ২৫ কেজি করে চাল দেওয়া হবে বলে জানা গেছে প্রশাসনসূত্রে। অভিযান পরিচালনার সময়, জেলা প্রশাসন, জেলা উপজেলা ম্যাজিষ্ট্রট, পুলিশ প্রশাসন, জেলা কমান্ড্যান্ট, উপজেলা প্রশাসনসহ পুলিশ মা ইলিশের প্রজনন মৌসুমে নদীতে সার্বক্ষনিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টহলে থাকবে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
বিজ্ঞাপন
এদিকে অভিযান শুরুর আগে থেকেই জেলেদের নৌকা ও জাল নদী থেকে উপরে তুলে রেখেছেন তারা। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার সময়ে সরকারি সহায়তা হিসেবে প্রতি বছরই ভিজিএফের ৮০ কেজি করে চাল জেলে কার্ড ধারী মৎসজীবীদের বিতরণ করা হত।
কিন্তু চলতি বছর আবার ৮০ কেজি চালের পরিবর্তে ২৫ কেজি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মৎস্য অধিপ্তর। সেই চাল এখনও বণ্টন করা হয়নি। এ সামান্য চাল দিয়ে তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে কিভাবে চলবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন জেলেরা। এ জন্য নগদ অর্থ প্রদানের দাবি জানিয়েছেন তারা।
স্থানীয় একাধিক জেলে ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন, নিষেধাজ্ঞার ২২ দিন ইলিশসহ সব ধরনের মাছ আহরণ থেকে তারা বিরত থাকবেন; কিন্তু বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান না থাকায় তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে চরম বিপাকে পড়তে হবে। এ ছাড়াও মহাজনের দেনা আর এনজিওর ঋণের কিস্তি নিয়ে তাদের দুচিন্তার শেষ নেই। তারা আরও বলেন, সরকারিভাবে যে ২৫ কেজি চাল দেওয়া হয়েছে, তা একেবারেই অপ্রতুল।
বরাট ইউনিয়নের অন্তরমোড় এলাকার জেলে নিশিকান্ত হালদার বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার সময় প্রত্যেক বছর ৮০ কেজি করে চাল দেওয়া হতো।কিন্তু এ বছর ২৫ কেজি করে দেওয়া হবে। দ্রব্য মূল্যের উর্ধগতির সময় এত অল্প পরিমাণ চাল দিয়ে আমাদের ২২ দিন চলা কষ্ট হয়ে যাবে।’
উড়াকান্দা এলাকার জেলে শান্তি হালদার বলেন, ‘২২ দিন আমরা নদীতে নামবো না। রোজগার বন্ধ থাকবে। নদীতে না নামলে আয়ও থাকবে না। পরিবার পরিজন নিয়ে সংসার চালাতে আমাদের কষ্ট হবে। সরকার যদি চালের সাথে কিছু আর্থিক সহায়তা করতো তাহলে আমাদের জন্য ভালো হতো।’
রাজবাড়ী মিজানপুর ইউনিয়নের গোদারবাজার এলাকার জেলে অচিন্ত্য হালদার বলেন, শুধু চাল খেয়ে তো আর বেঁচে থাকা যাবে না। তার ওপর এ বছর আবার চালের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। সরকার শুধু গরিবদের সাথেই পারে।’
সরেজমিনে গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ঘাট,সদর উপজেলার বরাট ইউনিয়নের উড়াকান্দা,অন্তরমোড়ের নদী তীরবর্তী এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, জেলেরা তাদের মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার নদীর তীরে উঠিয়ে রাখছেন। তাদের কেউ তাদের মাছ ধরার জাল রোদে শুকাতে দিয়েছেন। কেউ বা জাল গুছিয়ে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। অনেককে ছেড়া জাল তীরে বসে মেরামত করতেও দেখা গেছে।
দৌলতদিয়া ইলিশের আড়তে গিয়ে কথা হয় জেলে,পাইকার, আড়তদার, ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের সঙ্গে। সবার কণ্ঠেই হতাশা ও ক্ষোভ। ৫০ বছর ধরে পদ্মা ও যমুনায় ইলিশ ধরেন দৌলতদিয়া পদ্মা পাড়ের বাসিন্দা নেকবার আলি। প্রবীণ এই জেলে বলেন, ‘এই বচ্ছর পদ্মায় তেমন কোন ইলিশ পাই নাই, যা পাইছি তা জাটকা। এই জাটকা শিকার কইরা কোনো রহম জীবন ডা বাঁচাইছি। এইবার (নিষেধাজ্ঞার মধ্যে) যে পোলা-মাইয়া লইয়া কি খামু, আল্লায় জানে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক জেলে বলেন, ‘আজ ৪০ বছর ধরে পদ্মায় মাছ ধরি। কোনদিন এক কেজি চালও পাইনি। অনেকেই জেলে না হয়ে নিয়মিত চাউল পায়, অথচ যারা প্রকৃত জেলে যারা বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আবার রাজনৈতিক নেতাদের অনেক লোকও চাল পাচ্ছে।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘২২ দিনের মা ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞাকে সফল করতে এরই মধ্যে প্রচার-প্রচারণা করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার সময় জেলেদের নামে বরাদ্দকৃত সরকারি চাল দ্রুত বিতরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা মা ইলিশ রক্ষার নিষেধাজ্ঞা কঠোর করার সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি।’
যারা সরকারি আইন অমান্য করে নদীতে গিয়ে মাছ শিকার করবে তাদের জেল ও জরিমানা করা হবে বলে জানান তিনি।
দৌলতদিয়া নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির অফিসার ইনচার্জ(ওসি) জেএম সিরাজুল কবির বলেন, ‘২২ দিনের নিষেধাজ্ঞায় কোন জেলে পদ্মা নদীতে নামতে পারবে না। পুরো পদ্মা নদী জেলে শূন্য থাকবে। কোন বরফ কারখানায় মাছ মজুদ করা যাবেনা, কোন যানবাহনে মাছ পরিবহন করা যাবেনা। আমরা পদ্মা নদীতে সর্বক্ষণ নজরদারি করব। যারা আইন অমান্য করবে তাদেরকে আটক করে আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে।’
প্রতিনিধি/ এসএমডব্লিউ