আমরা চাই না নতুন প্রজন্ম আমাদের পেশায় আসুক
কামারপাড়ার কাছাকাছি পৌঁছাতেই কানে আসে টুংটাং শব্দ। দোকানে গিয়ে দেখা যায় কয়লার আগুনে উত্তপ্ত লাল লোহায় সজোরে আঘাত করে চলেছেন স্বপন কর্মকার। দাদা সুরেন কর্মকারের হাত ধরে স্বপনের বাবা কানাই কর্মকার এই পেশাকে স্থায়ীভাবে বেছে নেন। বাবার থেকে কাজ শিখে তৃতীয় প্রজন্ম হিসেবে এ পেশায় আছেন স্বপন কর্মকার (৪৫)।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মহিপুর বাজারের ‘কর্মকার কামার ঘর’-এর মালিক স্বপন কর্মকার। দাদা-বাবার জনপ্রিয়তা ও বিশ্বস্ততা ধরে রেখে কাজ করে চলেছেন স্বপন কর্মকার। মহিপুরে এখন মোট নয়টি কামার ঘর আছে। কিন্তু সবচেয়ে পুরোনো এবং বিশ্বস্ততা ধরে রেখে স্বপন কর্মকার ব্যবসা করে আসছেন কয়েক যুগ ধরে।
বিজ্ঞাপন
প্রতি বছর কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে স্বপনের দোকানে মোট ১২-১৫ জন কারিগর কাজ করেন। তাদের বেতন মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে নিয়মিত কর্মচারী তিন থেকে চারজন। কর্মচারীদের সঙ্গে স্বপন নিজেও কাজ করেন। তবে তিনি তার পরের প্রজন্মকে এই পেশা থেকে দূরে রাখছেন। তবে তারা এখন আর এই পেশায় ভালো নেই।
ঢাকা পোস্টকে স্বপন কর্মকার জানান, আট বছর বয়সে তিনি বাবা কানাই কর্মকারের সঙ্গে লোহা পেটানোর জন্য হাতে হাতুড়ি তুলে নেন। প্রথমে গরম লোহা পেটানোর কাজ করতেন। কয়েক দিন সেই কাজ করার পর তাকে দেওয়া হয় লোহা গলানোর কাজ। ধীরে ধীরে লোহা গরম করা, সেটা থেকে মালামাল বানানোর কাঠামো তৈরি, তারপর দা, বটি, কোদাল, চাপাতি ইত্যাদি তৈরি করা শেখেন।
বিজ্ঞাপন
স্বপন কর্মকার আরও জানান, বাবার মৃত্যুর পর এই দোকানটি তিনি নিজেই চালানো শুরু করেন। তখন থেকে তার সঙ্গে ভাই কেশব কর্মকার তাকে সহযোগিতা করেন। একপর্যায়ে দুই ভাই মিলে পরিচালনা করছেন এই দোকান। বর্তমানে এই দোকানের বয়স এক শ বছরেরও বেশি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, দোকানে দুই ভাই এবং দুইজন কারিগরসহ মোট চারজন কাজ করছেন। তারা সেখানে লোহা পেটানো, গলানো, ধারালো করা, আল কাটা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজ করছেন।
স্বপন কর্মকারের ছোট ভাই কেশব কর্মকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সবচেয়ে বেশি ব্যস্ততম সময় পার করি কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে। ওই সময় দা, বটি, কুড়াল, চাপাতি, ছুরিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম বিক্রি করে থাকি। তাই আমরা বছরের ব্যবসায়িক মৌসুম মনে করি ওই সময়টাকে।
কেশব কর্মকার আক্ষেপ করে বলেন, বছরের পর বছর এ শিল্প নিয়ে কাজ করলেও আমরা কোনো ব্যাংক ঋণ পাই না। তাই চড়া সুদে এনজিও থেকে ঋণ নিতে হয়। আর সেই ঋণ পরিশোধ করতেই আমাদের হিমশিম খেতে হয়।
পরের প্রজন্ম এ পেশায় আসবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তারা (স্বপন কর্মকার ও কেশব কর্মকার) ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিন পুরুষ ধরে আমরা এই কাজ করছি। আমাদের দোকানের বয়স ১০০ বছর কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাদের পুঁজি বলতে কিছুই নেই। দিন এনে দিন খেয়েই কেটে যাচ্ছে আমাদের জীবন। আর তাই পরের প্রজন্মকে এই পেশায় আনতে চাচ্ছি না।
এছাড়া, তারা মনে করছেন কালের পরিবর্তনে একটি সময় হয়ত বিলুপ্ত হয়ে যাবে এই ঐতিহ্যবাহী পেশা। কারণ আধুনিকতার ছোঁয়ায় দিন দিন এই শিল্পের প্রয়োজন কমে যাচ্ছে মানুষের কাছে।
এমজেইউ