ভালোবাসার বহু উদাহরণ আছে পৃথিবীতে। তবে তা হয়ে থাকে সাধরাণত স্বজাতিতে। কিন্তু পাখি ও মানুষের মধ্যে এমন ভালোবাসা সত্যিই বিরল। সন্তানের মতো ভালোবাসা-আদর দিয়ে পালন করা হচ্ছে বিদেশি জাতের জোড়া টিয়া পাখি সান ও এলেক্স। পাখি দুটিকে পালন করছেন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ৫নং কুমড়াবাড়ীয়া ইউনিয়নের জাড়গ্রামের মৃত আফজাল হোসেনের ছেলে আক্তারুজ্জামান ও তার স্ত্রী ফারিয়া আক্তার রিয়া।

সরেজমিনে দেখা যায়, ফারিয়া আক্তার রিয়া রান্না করেছেন। তার ঘাড়ে বসে সঙ্গ দিচ্ছে দুটি রঙিন টিয়া পাখি। তাদের সঙ্গে সন্তানের মতো খোসগল্পে রান্নার কাজ সারছেন তিনি। আবার আক্তারুজ্জামানকে দেখে পাখি দুটি ছুটে চলে যাচ্ছে তার কাছে। ছোট বাচ্চাদের মতো মুখে চুমু দিচ্ছে। এ যেন অদ্ভুত ভালোবাসার বন্ধন। পাখি দুটিকে মা-বাবার আদরে পালন করছেন তারা। পরম মমতায় বেড়ে উঠছে এই জোড়া টিয়া। 

ভালোবেসে তাদের নাম দেওয়া হয়েছে সান ও এলেক্স। তারা বাড়ির এ গাছ থেকে ও গাছে উড়ে যাচ্ছে, আবার ফারিয়া ডাকা মাত্রই উড়ে চলে আসছে। কখনো তার ঘাড়ে, কখনো তার মাথায় আবার কখনো হাতে সময় কাটাচ্ছে। মাত্র ৮ মাস বয়সী সান-এলেক্সকে নিয়ে আক্তারুজ্জামান ও ফারিয়া ঘুরে বেড়ান পুরো গ্রাম। পাখির সঙ্গে তাদের এমন ভালোবাসা দেখে অবাক সবাই। পাখিগুলো উত্তর-পূর্ব দক্ষিণ আমেরিকার সান কোনুর জাতের বলে জানা গেছে।  

জানা যায়, এক ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আক্তারুজ্জামান সবার ছোট। তিন বছর হলো বিয়ে করেছেন। তার নিজস্ব কম্পিউটারের দোকান আছে ঝিনাইদহের নগরবাথান বাজারে। সখের বশে তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি পাখি পোষেন। গত ৮ মাস আগে কুষ্টিয়া জেলা থেকে ২৪ হাজার টাকা দিয়ে ২০ দিন বয়সী এক জোড়া সান কোনুর জাতের টিয়া কিনেছিলেন। তখন তাদের চোখ ফোটা-ফোটা ভাব। সেই থেকেই তাদের সঙ্গে খায়, ঘুরে বেড়ায়, গোসল করে এই জোড়া টিয়া। 

আক্তারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওদের ভালোবাসায় আমরা মুগ্ধ। ওরা আঙ্গুর, আপেল এমনকি ভাতও খায়। আবার ঘুমায়ও আমাদের সঙ্গে। সকাল থেকে রাত অব্দি চলে বাবা-মা ও সন্তানের মতো আদর-শাসন। 

তিনি আরও বলেন, নিজেদের এখনো কোনো সন্তান হয়নি। ওরাই আমাদের সন্তান। আমার জানা মতে দেশের আইনে বন্যপ্রাণী পোষা বেআইনি। কিন্তু বিদেশি পাখি পোষা বৈধ। যার কারণে শখের বসে পাখি পুষি। এখন এই পাখিদের মায়াই পড়ে গেছি। এছাড়াও বিদেশি আরও চার জাতের ২০টি টিয়া পাখি রয়েছে।

প্রতিবেশী পলাশ মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, এমন ঘটনা সত্যিই বিরল। আমাদের এখানে এই প্রথম দেখলাম। অবাক করা ঘটনা। অবলা জীব পাখি কীভাবে সন্তানের মতো ভালোবাসছে মানুষকে। এই হানাহানির যুগে এমন ভালোবাসা দৃষ্টান্ত। ওদের দেখে আমারও এমন পাখি পালন করতে ইচ্ছে করে।

প্রতিবেশী রুহুল আমিন ঢাকা পোস্টকে জানান, তার দেখা এই প্রথম বিদেশি পাখি পোষ মেনেছে। পাখিগুলো সারাদিন বাড়ির চার পাশে এগাছ ওগাছ ঘুরাঘুরি করে। তবে বেশিরভাগ সময় আক্তারুজ্জামানের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে, ঘুরে বেড়ায়। পাখির সঙ্গে এমন ভালোবাসা বিরল।

আক্তারুজ্জামানের স্ত্রী ফারিয়া আক্তার রিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওরা আমার ভাষা বোঝে। আকার ইঙ্গিতও বোঝে। ওরা আমার সন্তান। ওদের ছাড়া যেমন আমি থাকতে পারি না, তেমনি ওরাও আমাদের ছাড়া থাকতে পারে না। বেশিরভাগ সময় ওরা আমার হাতে, মাথায়, ঘাড়েই সময় কাটায়। আমি ওদেরকে মায়ের আদর-ভালোবাসা-স্নেহ দিয়ে বড় করছি ।

তিনি আরও বলেন, আমাদের বিয়ে হয়েছে তিন বছর হলো। বিয়ের ছয় মাস পর থেকেই পাখি লালন পালন করি। তবে এই সান কোনুর জাতের টিয়া পাখি পোষার খুব ইচ্ছা ছিল। যে কারণে কুষ্টিয়া থেকে ২০ দিনের বাচ্চা কিনে আনেন আক্তারুজ্জামান। তার পর থেকে মায়ের স্নেহ দিয়ে ওদের বড় করেছি। এখন আমি ওদের যা বলি তাই শোনে। এক কথায় বাবা-মায়ের কাছে সন্তান যেমন, ওরা আমার কাছে তেমন আদরের।

ঝিনাইদহ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সুব্রত কুমার ব্যানার্জী ঢাকা পোস্টকে বলেন, মানুষের সঙ্গে পশুপাখির এমন সম্পর্ক খুবই বিরল। সাধারণত লাভবার্ড জাতের টিয়া পাখি সবাই পালন করে। আক্তারুজ্জামান ও ফারিয়া দম্পতি সান কোনুর জাতের টিয়া পাখির প্রতি যে ভালোবাসা দেখিয়েছেন, তার ফলস্বরূপ পাখিগুলো তাদের পোষ মেনেছে। ছোট থেকে কোনো পশুপাখিকে আদর ভালোবাসা দিয়ে লালন পালন করলে পোষ মানে। কিন্তু এই দম্পতির ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। পাখিগুলো তাদের বাবা-মা মনে করে। 

তিনি আরও বলেন, বণ্যপ্রাণী পোষার ক্ষেত্রে কিছু আইন আছে। যেগুলো বনবিভাগ বলতে পারবে। তবে যে কেউ বিদেশি জাতের টিয়া বা যে কোনো পাখি পালন করতে পারেন।

আরএআর